ঢাকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৯ ফাল্গুন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

শিশুশিক্ষায় একুশের বেদনা

মতামত

মো. সিদ্দিকুর রহমান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

শিশুশিক্ষায় একুশের বেদনা

মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বায়ান্নতে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা।তারা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে চেয়েছিলেন, সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলেও শিশুশিক্ষার প্রারম্ভে বেশি বেশি বিদেশি ভাষার প্রীতির বন্ধন থেকে আজও আমরা সর্বস্তর থেকে মুক্ত হতে পারিনি।

একুশ এলে, শহীদদের স্মৃতির প্রতি আমাদের উপচে পড়া ভালোবাসা জাগ্রত হয়। সভা-সমাবেশ, আলোচনা, একুশের বইমেলা, শহীদ মিনারের শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে ফুল দেয়াসহ নানা অনুষ্ঠান করে থাকি।‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি,’ এই মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদারক গানটি গেয়ে, আমরা শহীদদের প্রতি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি।

একুশ আমাদের মাঝে ঘুরে ফিরে আসে বারবার।একুশের প্রভাতে শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে হেঁটে আমরা ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসেবে পুষ্প অর্পণ করে থাকি।ধীরে ধীরে ফুল যেমন শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, তেমনি একুশের চেতনা আদর্শ ও লক্ষ্য আমাদের মাঝ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। বড় বড় পণ্ডিত, শিক্ষিতজন, শিক্ষকসহ আপামর জনসাধারণকে বক্তৃতা, সেমিনার, লেখালেখি, উপস্থাপন করতে দেখা যায়, একুশ আমাদের অহংকার, একুশে স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছে। এ ছাড়া নানা ধরনের বাক্যে একুশকে অলংকৃত করা হয়ে থাকে।শিশুদের শিক্ষার শুরু হোক মাতৃভাষায় নানা আবেগময় বক্তব্যে।

অথচ বেশির ভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যখন তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে এ ভাবনাটি থেকে সরে আসে, তখন তাদের একুশের প্রতি অঙ্গীকার বা বক্তব্য সবকিছু যেনো হারিয়ে ফেলে। শিশুর সূচনালগ্নে ইংরেজি, আরবি দিয়ে পাঠদান না করলে পরবর্তী সময়ে ইংরেজি আরবি বিষয়ে দক্ষ সাহেব তথা বিজ্ঞ আলেম তৈরি হবে না।এ ভাবনাটি তাদের ঘিরে ফেলে।

মাতৃগর্ভই শিশুর স্বর্গ। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে তার ওপর নেমে আসে, খাবার তথা লেখাপড়া নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন।সাধারণত ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশু মায়ের দুধ পান করবে। এ সময় মাতৃদুগ্ধ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যথেষ্ট। ধীরে ধীরে তরল খাবারসহ ক্রমান্বয়ে সুষম খাবার খাওয়াতে হবে।শিশুর খাবারের থলি অতি ক্ষুদ্র। অথচ শৈশবে তাদের অভিভাবকদের মুখে শিশু তেমন কিছু খায় না এ বাক্যটি সচরাচর শোনা যায়। তারা জোর করে যন্ত্রণা দিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর পরিবর্তে খাবার গেলাতে থাকে।

সাধারণত একবারও শিশুর খাবারের সামর্থ্য তথা বয়স, রুচির কথা বড়দের ভাবনায় আসে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ শিশু খাবার ও শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের নির্মম অত্যাচারের শিকার। ছোট শিশুদের প্রতি যাতনা হলো একুশের অন্যতম বেদনা।শিশুর সবচেয়ে বড় শিক্ষাদানের ক্ষেত্র তার নিকটতম পরিবেশ। আত্মীয় যেমন-বাবা-মা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, খালা, চাচা, ফুফুর কাছ থেকে শুনে ও দেখে শিশু প্রারম্ভিক শিক্ষা অর্জন করে থাকেন। শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়ে বৃহৎ পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। নতুন বা বৃহৎ পরিবেশ থেকে আমরা বড়রাও জ্ঞান অর্জন করে থাকি।লেখাপড়া না জানা জনগণও তাদের সার্বিক জ্ঞান পরিবেশ থেকে পেয়ে থাকেন। অতএব বিশদভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পরিবেশ সব মানুষের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্র।

আমাদের শিক্ষার ভাবনা হওয়া উচিত সহজ থেকে কঠিন বা জানা থেকে অজানার দিকে এগিয়ে নেয়া। আমরা শিশুদের প্রারম্ভিক শিক্ষা দিই ইংরেজি আরবি ও বাংলা অক্ষরজ্ঞানের মাধ্যমে।এই অক্ষর জ্ঞান শিশুর কাছে সম্পূর্ণ নতুন বা অজানা অর্থহীন কঠিনও বটে।এ বর্ণগুলো পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বল, বই, কলম, মা, বাবা, দুধ, খাবার, জামা, জুতা ইত্যাদি নানা ধরনের শব্দ দিয়ে আমরা অর্থপূর্ণ বাক্য বলে আমরা শিশুকে আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষাদান করতে পারি।শিশুর প্রথম পাঠ শুরু হওয়া প্রয়োজন পরিবেশের সহজ শব্দ বা বাক্যের মাধ্যমে।যে বাক্যটি শিশু প্রতিনিয়ত দেখে বা অংশগ্রহণ করে থাকেন। যেমন খাওয়া, খেলা, বেড়াতে যাওয়া।যেমন আমি বল খেলি, আমি ভাত খাই, মামার বাড়ি বেড়াতে যাই, মা আদর করেন।এভাবে পরিবেশের অর্থবোধক, যা তার জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত বাক্য বা শব্দ পাঠে শিশু আনন্দ পাবেন তা শিখবে।এতে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে।

ক্রমান্বয়ে শব্দ বা বাক্যের উচ্চারণের অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে ধারণা বা শিখতে থাকবে। আমরা শিশুকে সর্বপ্রথম বর্ণ সম্পর্কে ধারণা ও লিখতে দিয়ে থাকি।বর্ণ মুখস্থ করার মাঝে শিশু তেমন কোন আনন্দ পায় না।বর্ণ লেখা শিশুর শুরুতে কষ্টকর।দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও তারা বর্ণ বা অক্ষর সঠিক আকৃতি লিখতে পারেন না।কারণ, ছোট শিশুর ৬+ বছর বয়সের পর ক্রমান্বয়ে সঠিক আকৃতির বর্ণ লেখার সক্ষমতা অর্জন করে থাকেন।আমরা বড়রা চার বছর বয়স থেকে শিশুকে বর্ণলেখার অভিপ্রায়ে যন্ত্রণা দিই। সৃষ্টিকর্তা যথাযথ বয়সে লেখা সক্ষমতা দিয়ে থাকেন।আমাদের সিনিয়র সিটিজেনদেরও লেখার সক্ষমতাও অনেকটা শিশুদের মতো অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।মহান সৃষ্টিকর্তা ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ, ছয়মাস পর ধীরে ধীরে তরল খাবারের শেষে শক্ত খাবার দেয়া, ছয় বছর পর সঠিক আকৃতির লেখা, নামাজ পড়ার বয়স, বিয়ে বয়সসহ চাকরি বা কঠিন কর্ম করার বয়স আমাদের শরীরের সক্ষমতা এনে দিয়েছেন।সাধারণত শক্ত হাড় জাতীয় মাংস আমরা শিশুদের চিবিয়ে খেতে দিই না। অনুরূপভাবে বয়স, রুচি ও সামর্থের বাইরে শিক্ষা দান, জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে শিশু নির্যাতনের শামিল।ছোট শিশু আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসে। তাকে তার ইচ্ছে মতো আঁকাআঁকির মাধ্যমে সৃজনশীলতা তথা সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠতে দিতে হবে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে আমরা পরিবেশের বিভিন্ন শব্দ বা বাক্যের অক্ষর উচ্চারণ করে শেখানোর পাশাপাশি এলোমেলোভাবে লিখতে অভ্যস্ত করবো। একপর্যায়ে আমরা ৬+ বয়সের পর ধারাবাহিকভাবে বর্ণ বা অক্ষর শেখাবো বা লেখাবো। অধিক পরিমাণে খাবার যেমন শিশু তথা মানুষের শরীরের পুষ্টির তেমন কাজে আসে না।অনেক সময় বদহজম হয়ে বমি অথবা পেটে অসুখ হয়।অনুরূপভাবে বয়স, রুচি ও সামর্থের বাইরে শিক্ষা শিশুর শারীরিক মানসিক বৃদ্ধি বাঁধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।

এজন্য শিশু শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ মেধাবী জনবল প্রয়োজন।শিশু শিক্ষায় একুশের বেদনা নিরসনের জন্য কতিপয় পরামর্শ উপস্থাপন করছি। -

১. সরকারি-বেসরকারি তথা কিন্ডারগার্টেনসহ সব শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও পিটিআই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমানে কর্মরত সব বেসরকারি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জরুরি ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের বাহিরে শিশুর বয়স রুচি ও সামর্থের বিবেচনা করে মেধা বিনাশকারী সব বই ছাপানো বা পাঠদান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

৩. শিশুশিক্ষার জন্য খেলাধুলা তথা বিনোদনবিহীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে।

৪. সরকারি ও বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুপুরে মধ্যে তাদের পাঠদান কার্যক্রম সমাপ্ত করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা দুপুরের গরম খবর খেয়ে বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে বিকাল বেলা ফুরফুরে মেজাজে সুস্থ মস্তিষ্কে খেলাধুলা বা ঘুরে বেড়াতে পারে । এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটবে।

৫. একুশের হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা হলো শিক্ষকদের থার্ড ক্লাস মর্যাদা রাখা। মর্যাদা ও বেতন বৈষম্যের কারণে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে দূরে থাকেন।যার ফলে একুশের শহিদ তথা আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশে জাতি মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানসমৃদ্ধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জাতিকে সমৃদ্ধ তথা একুশের এর চেতনায় গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে শিশু শিক্ষায় একুশের বেদনা দূর করার প্রত্যাশা করছি।

লেখক: শিক্ষাবিদ

 

জনপ্রিয়