
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেকেই ইএফটি বিড়ম্বনার শিকার হয়ে গত জানুয়ারি মাসের বেতন চলতি ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেও হাতে পাননি। এই মাসেও পাবেন কি না সন্দেহ আছে। সময়মতো বেতন না পেলে কতো দুর্ভোগ আর মানসিক কষ্ট পেতে হয়, সে কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। যারা বেতন ছাড় দেন, শিক্ষাভবন কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসি রুমে বসে আকাম-কুকাম করেন, ঘুষ বাণিজ্যে হাজার হাজার টাকা কামাই করেন, তারা এ জ্বালা বুঝবেন কী করে? তাদের বেতনের চিন্তা নেই। বাম হাতের কারবারে পুরো মাসের খরচ বাদে আরো টাকা উদ্ধৃত্ত থাকে।
এই টাকায় বউয়ের নামে ফ্ল্যাট কেনেন। ছেলেমেয়ের নামে গাড়ি কেনেন। আরো কতো কী! এরা শিক্ষকদের মনে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পান। তৃপ্তি লাভ করেন। কেমন শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করে এরা বড় হয়েছেন, কে জানে? শিক্ষকদের সম্মান দেখিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যাদের এতোটুকু মনুষত্ব ও মানবিকতা জাগ্রত হয় না, তারা কেমন মানুষ? শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর, শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষাভবন এমনকি শিক্ষামন্ত্রণালয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক প্রেষণে উচ্চ পদে কর্মরত থাকেন।
সেখানে তারা নিজেদের শিক্ষক পরিচয়ের আড়ালে অফিসার সেজে বেটাগিরি জাহির করতে পছন্দ করেন। এরা শিক্ষক হয়েও যখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দুঃখ কষ্ট এতোটুকু উপলব্ধি করতে চান না, তখন এদের জন্য করুণা হয়। মনে মনে বলি- মাবুদ, এদের তুমি জ্ঞান দাও। তুমি এদের মানুষ করো। আমার শিক্ষকতা সময়ে বেশ কটি মিনিস্ট্রি অডিট পেয়েছি। মিনিস্ট্রি অডিটের বেশিরভাগ কর্মকর্তা ‘খায় মামু’। এদের স্বভাব ‘খাই খাই’ করা ছাড়া কিছু নয়। এরা কোনো না কোনো সরকারি কলেজের শিক্ষক। হাজারে এক দুজন ভালো মানুষের দেখা মেলে। এরা বেশিদিন টিকতে পারেন না।
নিজে খান না বলে ঊর্ধ্বতনকে খাওয়াতে পারেন না। ফলে যেকোনো অজুহাতে ডেপুটেশন বাতিল হয়ে আগের জায়গায় ফিরে যেতে হয়। শিক্ষা ভবনের মতো জায়গায় ঘুষ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট থাকে। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সমঝোতায় নিচ থেকে ঘুষের টাকা ওপরে পৌঁছে। যে অজুহাতে ইএফটি বিড়ম্বনার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, সেটি শিক্ষা ভবনের লোকেরা এমপিওভুক্তির সময় সৃষ্টি করে রেখেছেন। নামের বানানে ভুল, জন্ম তারিখে ভুল, বাবার কিংবা মায়ের নামের ভুল, দাঁড়ি-কমায় ভুল সবই তাদের কারসাজি। তারা ইচ্ছে করে আগে এসব করে রেখেছিলো। নিজেরা সুফল আর শিক্ষক-কর্মচারীদের কুফল ভোগ করাবে বলে।
আজ নিরীহ শিক্ষক-কর্মচারীরা হাড়ে হাড়ে এর কুফল ভোগ করছেন। একা নয় পরিবার পরিজন ও স্বজনদের নিয়ে। আমি নিজে আজ ব্যক্তিগতভাবে এই জাতীয় দুঃখ দুর্গতির বাইরে হলেও ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য কষ্ট হয়। ভাবতে অবাক লাগে, দেশে বৈষম্যবিরোধী এতো বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেলো। অথচ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা আজও বৈষম্যের পাহাড়ের নিচে পড়ে রইলেন। তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে একটা আন্দোলন সফল করলো। অথচ নিজেদের স্যারদের বৈষম্যের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এলো না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন সমর্থিত সরকার আজ ছয় মাসের ওপর ক্ষমতায়।
এই অন্তর্বর্তি সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য ককোটুকু কী করে, কে জানে? অন্তত ইতোপূর্বে গঠিত বেশ কটি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করলে একটু হলেও আশার আলো দেখতে পেতাম। কেনো জানি তারা সেটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় মনে হয়, এই সংস্কার কমিশনটি সর্বাগ্রে হওয়া উচিত ছিলো। উপদেষ্টা পরিষদে বেশ কজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ রয়েছেন। তাই একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের বিষয়ে আমরা সবাই এক প্রকার আশ্বস্ত ছিলাম। অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠিত হলে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ অনেকটা উপকৃত হবার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারতো।
বর্তমান সরকারের হাতে যেটুকু সময়, তাতে তারা শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন কিংবা শিক্ষা সংস্কারের জন্য তেমন কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্তত একটা কমিশন গঠন করে যেতে পারলে কিছুটা হলেও আশা করা যেতো। আমাদের দেশে কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে শিক্ষা খাতকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না। শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর আর শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড-এসব এখন কথার কথায় পরিণত হয়েছে। তা না হলে শিক্ষকের মর্যাদা আর শিক্ষার মান এতো তলানিতে কেনো? কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষানীতি, সিলেবাস, কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয় বটে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধ শতাব্দী পেরিয়েও আজ পর্যন্ত যুগোপযোগী ও নিরপেক্ষ শিক্ষানীতি, সিলেবাস, কারিকুলাম কোনোটিই পাইনি, যা পেয়েছি সব জগাখিচুড়ি। যারা যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা তাদের মতো করে এগুলো প্রণয়ন করেছে।
ইচ্ছে করে বার বার সঠিক ইতিহাস থেকে নতুন প্রজন্মকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ আর অবকাঠামো তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা শিক্ষা প্রশাসনের অসাধু লোকজন আত্মস্যাৎ করে। অথচ শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের ভাতাটুকু যথাযথভাবে পান না। প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল সময় মতো সরবরাহ করা হয় না। বাজার খরছ করার ব্যাগের চেয়ে আরো কম দামের বাজে একেকটা ব্যাগ স্যারদের দেয়া হয়। এই ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে চলাফেরা করতে লজ্জা লাগে। প্রশিক্ষণকালীন শিক্ষকদের নিম্নমানের টিফিন, নাস্তা, চা, কফি দিয়ে আপ্যায়ন করানো হয়। এসব বানিয়ে বলছি না। দীর্ঘ তিন যুগে নিজে অনেক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়েছি। মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করেছি। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে এ বিষয়গুলো তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভবন, ল্যাব, বাউন্ডারি, শিক্ষা সামগ্রী খাতে যতো বরাদ্দ দেয়া হয়, তার সিংভাগ টাকা দুর্নীতিবাজদের পকেটে যায়। শিক্ষকদের বেতন, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা এবং ঈদ উৎসব ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শত আন্দোলন করেও কারো মন গলানো যায় না।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যে সিকি আনা এ উৎসব ভাতা চালু করা হয়েছিলো, আজও তা বহাল আছে। শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত না করলে শিক্ষার মান বাড়বে কী করে, এ কথাটি কেউ মানতে চায় না। তাদের ভাবখানা এই যে, শিক্ষকদের যতো কম দেয়া যায়, ততো ভালো। স্থানীয় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত মুখে মুখে সব শিক্ষকদের দরদ দেখায়। মর্যাদার আসনে বসিয়ে রাখে। মাথার তাজ বানিয়ে রাখার কথা বলে। কিন্তু শিক্ষকদের কজনে মন থেকে সম্মান করে? এর প্রধান কারণ শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা। একজন বেসরকারি শিক্ষকের পরিবার পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের গ্যারান্টি না থাকলে মানসম্মত শিক্ষা কে দেবে? পাঁচশ টাকা চিকিৎসা ভাতা, এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া আর সিঁকি আনা বোনাসের টাকা একজন শিক্ষকের জন্য লজ্জাকর বিষয় বটে। এ থেকে শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলা ও বৈষম্যের চিত্রটি করুণভাবে ফুটে ওঠে। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।
আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কে শোনে কার কথা? রমজানের আর কদিন মাত্র বাকি আছে। এরপর ঈদুল ফিতর। সংগত কারণে রমজান মাস ও ঈদ মিলে অন্য স্বাভাবিক তিন মাসের সমান খরচ হয়। রমজান আসার আগেই দুশ্চিন্তায় অনেকের মাথা মগজ নষ্ট হবার উপক্রম। কী করে রমজান মাস ও ঈদের ব্যয় সংকুলান করবেন সে চিন্তা অনেককে কুরে কুরে খেতে থাকে। এজন্য শিক্ষকদেরও কম দোষ দেই না। বহুধা বিভক্তি এবং এক শ্রেণির শিক্ষকদের সরকারি লেজুড়বৃত্তি শিক্ষক-কর্মচারীর সর্বনাশের মূল কারণ। শিক্ষকরা যতোদিন সরকারি লেজুড়বৃত্তি ছাড়বেন না, ততোদিন শিক্ষক সমাজের দুর্দশা ও দুর্গতির অবসান হবে না। আমি বুঝি না, শিক্ষকদের কেউ কেউ চাটুকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কেনো? সরকারের দালালি করেন কেনো? রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন কেনো? এসবে আত্মমর্যাদায় লাগার কথা। ‘শিক্ষক আমি সবার বড়’-এই কথাটি সব শিক্ষকের বুকে ধারণ করা উচিত। আত্মমর্যাদাহীন কথিত শিক্ষক নেতারা সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের ডুবিয়ে মারেন। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের বড় বড় পদগুলো দখল করে নেন। অবসরকালে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীরা এদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। এদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে আপস না করলে জীবিতকালে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার টাকা নসিবে জোটা মুশকিল হয়ে ওঠে। এ কারণে অবসর ও কল্যাণের টাকার মুখ না দেখে কতো শিক্ষক-কর্মচারী কবরবাসী হয়েছেন, তার হিসেব কে রেখেছে? হায় সেলুকাস। কী বিচিত্র দেশ।
আজ কদিন থেকে জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোটের ব্যানারে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী শতভাগ উৎসব ভাতা এবং সরকারি নিয়মে বাড়িভাড়ার দাবিতে লাগাতার অবস্থান কর্মসুচি শুরু করেছেন। তারা ‘লং মার্চ টু যমুনা’, ‘লং মার্চ টু সেক্রেটারিয়েট’ আরো কী কী কর্মসুচি পালন করেছেন। তাদের দাবি একান্ত ন্যায্য ও যুক্তিসংগত। কিন্তু, তাদের দাবি দাওয়া কেউ আমলে নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। আবার অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে আরেকটি সংগঠন রোজার আগে একটি কর্মসুচি পালন করবে বলে শোনা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এই অন্তর্বর্তি সরকার রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে শতভাগ ঈদ বোনাসের বিষয়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সমর্থিত সরকারের হাতে অন্তত এই একটি বড় বৈষম্য আপাতত অপসারিত হোক, সেটি আমরা চাই। তা না হলে বিপ্লবোত্তর এই সরকার এবং অন্য সরকারগুলোর মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।
স্বাধীন বাংলাদেশে সবকটি সরকার দেখেছি। আমি যখন শিক্ষকতায় প্রথম আসি, তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার ক্ষমতায়। একটি সামরিক সরকারের কাছে মানুষের তেমন প্রত্যাশা থাকে না। শিক্ষকদের তো নয়-ই। আমার হেড স্যার, যিনি আমার সরাসরি শিক্ষক, প্রায়ই বলতেন কোনোদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বেসরকারি স্কুল-কলেজ সরকারি করে নেবে। বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করবে। তাদের আর তেমন কোনো সমস্যা অবশিষ্ট থাকবে না। স্যার আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী কোনোটিই ছিলেন না। কিন্তু, একান্ত এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি কথাটি বলতেন বলে আমার কাছে মনে হতো। আওয়ামী লীগ সরকারে এলে বেসরকারি স্কুল-কলেজ সরকারি হবে, এ কথা আরো অনেকের মুখে শুনেছি। আওয়ামী লীগ তো কয়েকবারই ক্ষমতায় এলো। কিন্তু, কিছুই করে যায়নি। বিএনপির কাছেও অনেকের এ রকম প্রত্যাশা ছিলো।
তারাও শিক্ষকদের তেমন কিছু দিয়ে যায়নি। এভাবে শত প্রত্যাশার ভেতর কতো সরকার এলো আর কতো সরকার গেলো, কিন্তু শিক্ষকদের সব আশা নিরাশার দোলাচলে আজো ঘূর্ণায়মান রয়ে গেলো। একটা বিপ্লবোত্তর সরকার এখন দেশের ক্ষমতায়। রাষ্ট্রীয় মৌলিক নানা বিষয়ে সংস্কারের প্রত্যয় নিয়ে তারা দেশ পরিচালনা করছেন। তারা শিক্ষা ও বেসরকারি শিক্ষকদের দুর্গতির দিকে চেয়ে অন্তত একটা কিছু করে যান সেটি আমরা চাই। সম্ভব হলে একটা শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে দিয়ে যান। বিপ্লবের সুফল অন্তত কিছুটা যাতে শিক্ষক সমাজ পেতে পারে, সেই সুযোগটি তৈরি করে দিয়ে প্রধান উপদষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টাকে ইতিহাসের অংশ হবার অনুরোধ জানাই।