
আজ ৩ মার্চ ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’। জাতিসংঘ থেকে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মূলত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও উদ্ভিদকুল রক্ষায় সচেতনতা তৈরিতে দিবসটি পালন করা হয়। পৃথিবীতে নানা কারণে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে। বন্যপ্রাণী কমে যাওয়ার জন্য মানুষের অযাচিত কর্মকাণ্ডকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়। সব উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল নিয়েই এ সৃষ্টিজগত। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি প্রতিটি প্রাণীর কোনো না কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করেই চলছে এ বসুদ্ধরা। বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান ব্যতীত এ পৃথিবী টিকবে না। মানুষ ছাড়া বন্যপ্রাণীরা টিকে থাকতে পারবে কিন্তু বন্যপ্রাণীদের সহাবস্থান ছাড়া মানুষ টিকে থাকতে পারবে না। মৌমাছি তার পরাগায়ন বন্ধ করে দিলে, সুন্দরবনের বাঘ না থাকলে, বনে হাতি না থাকলে কী অবস্থা হবে চিন্তা করা যায়! মানুষ যখনই সবকিছু নিজের মনে করে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড করে চলেছে ঠিক তখনই তা বন্যপ্রাণীর জন্য মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে বহু বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, আবার অনেক প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ (আইইউসিএন) বাংলাদেশ-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ৯২০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬৬ প্রজাতির পাখি, ১৬৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও ৪৯ প্রজাতির উভচর। প্রকৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার আরেক তথ্যে বলা হয়েছে, গত ১০০ বছরে দেশে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী চিরতরে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিয়ে রয়েছে আরো ৯০ প্রজাতির প্রাণী। বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে মন্থর ভালুক, কৃষ্ণষাড়, বাদা হরিণ, ভারতীয় গন্ডার, সুমাত্রা গন্ডার, জাভা গন্ডার, বনগরু, বনমহিষ, ধূসর নেকড়ে, নীলগাই, ডোরাকাটা হায়েনা, সবুজ ময়ূর, মিঠাপানির কুমির, গাছ আঁচড়া, লাল মাথা টিয়াঠুঁটি, দাগি বুক টিয়াঠুঁটি, ধলাপেট বগ, রাজ শকুন, সাদাফোঁটা গগন রেট, বাদি হাঁস, গোলাপি হাঁস, মদনটাক, বাদা তিমির, ধূসর মেটে তিমির, সারস, লালমুখ দাগিডানা ইত্যাদি। তথ্যে বলা হয়েছে আরো ৩৯০টি বন্যপ্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন তালিকায় রয়েছে।
এদের মধ্যে মহাবিপন্ন প্রাণী ৫৬টি, বিপন্ন ১৮১টি এবং ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫৬টি প্রজাতি। বন্যপ্রাণী তহবিলের হিসেবে মতে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১ লাখ। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের জরিপে বিশ্বের বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় চার হাজার। বাংলাদেশে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৪৪০টি। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের জরিপে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৬টি। পরিবেশবাদী গ্রুপ ‘উব্লিউউব্লিউএফ’ ও ‘যুলোজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন’-এর তথ্য মতে বিশ্বে গত ৪০ বছরে বন্যপ্রাণী কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী বন উজাড় করা হচ্ছে। বন ধ্বংস হলে বন্যপ্রাণী রক্ষা করা অসম্ভব-এটা নিশ্চিত। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য থেকে আসে। প্রকৃতিকে নিয়েই সুবিশাল জীববৈচিত্র্য। মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা মানে নিজেদের পায়ে কুড়াল দিয়ে আঘাত করা।
সর্বভুক ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ মানুষের সংখ্যা যতো বাড়ছে পৃথিবীতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ততোই কমছে। জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা’র (এফএও) তথ্য মতে, ২০০০ থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৫ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড় শতাংশ বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বন্যপ্রাণীর খাদ্যের ঘাটতি হচ্ছে। আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার ফলে প্রাণীরা আপন পরিবেশে টিকে থাকতে পারছে না। দেশে যত্রতত্র জলাভূমি, নদী ও লেক ভরাট করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংকট, চোরা শিকার, হাওরে চায়না জালের ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার, দুর্বল আইন ও দূষণ বন্যপ্রাণীর ক্ষতিকে ত্বরান্বিত করছে। বন পুড়িয়ে বসতবাড়ি তৈরির ফলে বন্যপ্রাণীর প্রজননস্থান নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বন্যপ্রাণীদের বড় একটা অংশ পাচার হয়ে যায়। খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকার আশপাশ থেকে মিয়ানমার, ভারত ও চীনে বন্যপ্রাণী পাচারের তথ্য বন বিভাগের গবেষণায় উঠে এসেছে। পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীর তালিকায় রয়েছে হরিণ ও বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তক্ষক, সাপ ও কচ্ছপ ইত্যাদি। এ ছাড়া জলবায়ুগত সমস্যার কারণে বন্যপ্রাণীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে অনেক বন্যপ্রাণী খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে অনেক বন্যপ্রাণীর বিনাশের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বন্যপ্রাণীরা বনে কিংবা খাঁচায় কোথাও ভালো নেই। বন্যপ্রাণীদের তাদের মতো করে থাকতে দিতে হবে। সচেতনতার অভাবে অনেক বন্যপ্রাণীকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। যেখানে বন্যপ্রাণীদের থাকার কথা ছিলো সেখানে মানুষের আবাস গড়ে তোলা হচ্ছে। মানুষকে তার নিজেদের স্বার্থে বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হবে। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’- এ সত্য আরো বেশি করে অনুধাবন করার সময় এসেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে বন্যপ্রাণী রক্ষার বিকল্প নেই। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে প্রাণী রক্ষায় সচেতন হতে হবে।
লেখক: শিক্ষক