ঢাকা রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫ , ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

আমাদের শিক্ষায় যতো গলদ

মতামত

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৪ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

আমাদের শিক্ষায় যতো গলদ

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি, কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক এসব নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যথা কারো আছে বলে মনে হয় না। না সরকারের, না শিক্ষাবিদদের, না অভিভাবকদের, না শিক্ষার্থীদের। অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাদের অনেকেই এসব তেমন একটা বোঝেন না। বেশিরভাগ লেখাপড়া না জানা বা কম জানা মানুষ। শিক্ষার্থীদেরও করার কিছু নেই। তাদের যা গিলতে দেয়া হয় সেটি তারা গলাধঃকরণ করে। অন্যদিকে শিক্ষকদের কিছু করার থাকলেও তারা তেমন একটা সুযোগ পান না। সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যবই ইত্যাদি প্রণয়ন, পরিশোধন ও পরিমার্জনে তাদের অংশগ্রহণ একেবারে নগণ্য থাকে।

প্রকৃতপক্ষে এ কাজগুলো পুরোটাই শিক্ষকদের দিয়ে করানো উচিত ছিলো। কিন্তু আমাদের দেশে এসব কাজে তেমন একটা তাদের ডাকা হয় না। দু-এক জনকে ডাকা হলেও স্বজনপ্রীতি কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায়, যোগ্যরা তাতে স্থান পান না। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা কিংবা স্বজনপ্রীতির কারণে এমন অনেকে সুযোগ পেয়ে থাকেন, যারা এসব কাজে দক্ষ নন। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পড়েন না। বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা এসব কাজে সুযোগ পেলে দেশ ও জাতির অনেক উপকার হতো। 

নতুন প্রজন্ম যুগোপযোগী সিলেবাস ও কারিকুলামের সাহায্যে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারতো। নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পেতো। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো একটি দক্ষ জনশক্তি আমরা পেতে পারতাম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষকরাই এসব কাজ করে থাকেন। আমাদের দেশে শিক্ষা কমিশন, শিক্ষাবোর্ড, এনসিটিবি ইত্যাদিতে আমলা-কামলা ও রাজনীতিকদের শকুনের নজর থাকে। কীভাবে এসবে নিজেদের লোক দেয়া যায়। কীভাবে সম্মানীর কাড়ি কাড়ি টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়। এর ফলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং প্রথিতযশা শিক্ষাবিদরা কদাচিৎ শিক্ষা সংক্রান্ত কমিটিতে স্থান পেয়ে থাকেন। আমলা-কামলা আর রাজনীতির আশীর্বদে যারা আসেন, এরা শিক্ষার কী বোঝেন? ফলে যা হবার তাই হয়। যুগোপযোগী সিলেবাস, কারিকুলাম এবং নির্ভুল পাঠ্যপুস্তক থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়। যথাযথ কারিগরি শিক্ষার অভাবে আমাদের জনশক্তি একান্ত অদক্ষ, সেটি বাইরের দেশের লোকজন ভালো করে জানে। পৃথিবীর খুব কম দেশ আছে যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিক নেই। অথচ বিদেশে আমাদের শ্রম বাজার খুবই সস্তা।

যে কাজে একজন ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি শ্রমিক সত্তর হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা বেতন পান, সেই একই কাজে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক মাত্র ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। আমাদের পড়ালেখায় দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার অভাব, কারিগরি শিক্ষার অভাব ও আইসিটির জ্ঞানের অভাব। যেনতেন সিলেবাস ও কারিকুলামে আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা পড়াশোনা করিয়ে থাকি। সিলেবাস, কারিকুলাম কিংবা পাঠ্য বইয়ের প্রতি আমাদের খেয়াল নেই। যখন যারা ক্ষমতায় আসে, তখন তারা নিজেদের মতো করে এসব প্রণয়ন করে। নিজেদের ছা-পোষা বুদ্ধিজীবিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো করে শিক্ষানীতি দাঁড় করায়।

শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর নামে টাকা পয়সা হরিলুটের মহোৎসব চলে। এতো কিছুর পরেও আমাদের সন্তানদের মেধার প্রশংসা করতে হয়। তাদের যথার্থ সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যবই দিতে পারলে তারা সর্বক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারতো। তারা দক্ষ ও যোগ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো। বিদেশে বিশেষ করে সৌদি আরব ও লন্ডনে বাংলাদেশি অনেক ছেলেমেয়েকে দেখেছি, যারা সেখানে একান্ত নিজের চেষ্টায় বহুমুখী দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছে। এমন অনেককে দেখেছি যারা দেশে কেবল হাল চাষ করতে পারতো অথচ বিদেশে গিয়ে এখন ভালো কুকিং জানে, ক্যাটারিংয়ের কাজ করে, ড্রাইভিং করতে পারে। কেউ কেউ কম্পিউটার, ইন্টারনেট চালাতে পারে। অনেকে ট্যাক্সি চালিয়ে ভালো টাকা ইনকাম করে। রেস্টুরেন্টে শেফের কাজ, ওয়েটারের কাজ করে অনেক টাকা কামাই করে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। দায়ে পড়ে এসব তাদের শিখতে হয়েছে। আমাদের সন্তানদের বহুমুখী প্রতিভা আছে। কেবল যথাযথ সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যবই ও শিক্ষাব্যবস্থার অভাবে তাদের প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে পারি না।

এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটি বড় রকমের ব্যর্থতা। বারবার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সিলেবাস, কারিকুলাম এবং পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করি। এসব পরিবর্তনে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়। এই বিষয়টি কর্তা ব্যক্তিদের মাথায় ঢোকে না। আমাদের সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্য বইয়ে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। মুল্যায়ন পদ্ধতিও ত্রুটিপূর্ণ থাকে। ফলে আমাদের সন্তানদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, এনসিটিবি, শিক্ষাবোর্ড-এরা সবাই মিলে কী করে? যুগোপযোগী সিলেবাস, কারিকুলাম এবং যথার্থ ও নির্ভুল পাঠ্যপুস্তক দিতে না পারলে এদের অবশিষ্ট কাজের কোনো দাম নেই। শিক্ষাবর্ষের শেষের দিকে বোর্ডের এক কপি সিলেবাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়। যেটি বছরের শুরুতে পৌঁছে দেবার কথা।

যখন পৌঁছে তখন সেটি খুলে দেখার মতো সময় হাতে থাকে না। বছরের শুরুতে সেটি পাঠানো যায় না কেনো, সেটি একটি বড় প্রশ্ন? হেন ফি, তেন ফি আদায় করে একেকটি শিক্ষা বোর্ড বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করে। অথচ সময় মতো একটি সিলেবাস পাঠাতে পারে না। বড় অঙ্কের বেতন আর সম্মানী নিয়ে অনেকে নিজের শরীর স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। নামে বেনামে অঢেল সম্পদ অর্জন করে। স্বয়ং নিজের, বউয়ের এবং ছেলেময়েদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। মনে হয় দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। স্বায়ত্তশাসনের নামে অন্য রকম স্বাধীনতা ভোগ করে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই বললে চলে। বছরে বার মাসের বেতন বাদে দুটোর জায়গায় পাঁচ-ছয়টা করে বোনাস নেয়। সিকি বা আধুলি নয়। ষোল আনা উৎসব ভাতা। শিক্ষকদের সিকি আনা বোনাস দিয়ে শিক্ষা বিভাগের লোকজন তৃপ্তির ঢেকুর ছাড়ে। খণ্ডিত বোনাস কেবল শিক্ষকদের নসিবে।

হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশের মানুষ। রোজা ও ইদকে সামনে রেখে আজ দশ-পনের দিন থেকে শতভাগ বোনাস আর সরকারি নিয়মে বাড়িভাড়ার জন্য শত শত শিক্ষক প্রেস ক্লাব চত্বরে অবস্থান কর্মসুচি পালন করছেন। কেউ তাদের এতোটুকু খবর নিচ্ছে না। রোজার দিনে উপোস থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকেরা কতো কষ্টে ঢাকার রাজপথে পড়ে আছেন। কারো টনক নড়ছে না। সরকারের দায়িত্বশীল যারা, তারা চোখ বন্ধ করে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। তারা শিক্ষকদের বুঝিয়ে অন্তত শতভাগ উৎসব ভাতা দিয়ে বিদায় করে দিতে পারতো। শিক্ষা উপদেষ্টাও কী এসব খবর রাখেন না? তাহলে কি এ কথাই সত্যি, ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’। এদেশে শিক্ষার উন্নতি কী করে হবে? শিক্ষকদের উপোস রেখে, অপমান আর অসম্মান করে পৃথিবীতে কোনো জাতি বড় হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শুনিনি।

যুগ-যুগান্তর ধরে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ বৈষম্যের নির্মম শিকার। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যের ছাপ বিদ্যমান। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও চালিত স্কুলে ভিন্ন ভিন্ন সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও সম্মানীতে সুস্পষ্ট তারতম্য। শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানো কার্যকলাপে ভিন্নতা পরিলক্ষিত। মুল্যায়ন প্রক্রিয়াও ভিন্ন রকম। একই পাড়ায় বাস করে কোনো শিশু সরকারি প্রাইমারিতে পড়ে। কোনো শিশু কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। কেউ এনজিও চালিত বিদ্যালয়ে পড়ে। একেক প্রতিষ্ঠানে একেক নিয়ম।

সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যবই যার যার আলাদা। সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমেও ভিন্নতা। এইসব পার্থক্য শিশুদের জীবন পরিক্রমায় পৃথক পৃথক ছাপ ফেলে। ভিন্ন মনন ও মানসিকতা নিয়ে একেক শিশু বেড়ে উঠে। একই দেশের ভেতর এটি আদৌ কাম্য হতে পারে না। সব শিশুকে বেড়ে ওঠার অভিন্ন সুযোগ তৈরি করে না দিতে পারার কারণে সমাজে বৈষম্যের সুত্রপাত হয়। এখানেই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে। শিক্ষার সব স্তরে একই অবস্থা। ধর্মীয় শিক্ষায় প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি কোনো নজরদারি তত্ত্বাবধান নেই। মুসলিম শিশুদের বেসরকারি পর্যায়ে প্রত্যেক এলাকায় মক্তব শিক্ষা চালু থাকলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শিশুদের ধর্ম শিক্ষা শেখার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। মক্তব শিক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মোটেও নেই বললে চলে। ইদানিং কয়েক বছর থেকে ইসলামি ফাউন্ডেশন মসজিদ ভিত্তিক মক্তব শিক্ষা চালু করেছে।

এটি সর্বত্র চলমান নয় এবং খুব একটা ফলপ্রসু মনে হয়নি। অন্য ধর্মাবলম্বী শিশুদের জন্য এমন কোনো কার্যক্রম আছে বলে জানা নেই। থাকলে থাকতেও পারে। নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক জ্ঞান শিশু মনে জাগিয়ে দিতে সরকারি প্রয়াস অপরিহার্য। এ বিষয়ে কোনো সরকারের আন্তরিকতা আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। মূলত ধর্মীয় শিক্ষা শিশু মনে নৈতিক শিক্ষার বীজ বপন করে। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া মানবজীবন একটি অর্থহীন অধ্যায় বৈ কিছু নয়। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া মানুষের ভেতর নৈতিকতা ও মানবতা জাগিয়ে তোলা যায় না। নৈতিকতা ও মানবতা বিবর্জিত মানুষ প্রকৃত মানুষ নয়। এদের সঙ্গে পশুদের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া ভার। প্রাথমিক শিক্ষা ও ধর্মের মৌলিক জ্ঞান শিশু মানসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মানবজীবনের ভিত্তি এই স্তরে গড়ে ওঠে।

তাই প্রাথমিক শিক্ষাস্তর এবং প্রত্যেকের ধর্মীয় মৌলিক বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া একান্ত প্রয়োজন। অন্তত প্রাথমিক লেভেলে অভিন্ন সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক এবং একই রকমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শিশুর শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মক্তব ভিত্তিক শিক্ষার ন্যায় অন্যান্য ধর্মের শিশুদের জন্য মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডা ভিত্তিক শিশু শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা দরকার। এ ছাড়া মাদরাসা শিক্ষায় কওমি ও সরকারি ধারার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দৃশ্যমান। কওমি মাদরাসাসমূহে অনেকগুলো শিক্ষাবোর্ড এবং যার যার সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক স্বতন্ত্র। সরকারি মাদরাসাসমুহের সারা দেশে একটিমাত্র শিক্ষাবোর্ড এবং তাদের সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক অভিন্ন। কওমি মাদরাসমুহের সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যবই এবং পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা সেকেলে। সরকারি মাদরাসাসমুহের সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যবই এবং পরীক্ষা পদ্ধতি তেমন যুগোপযোগি নয়। মাদরাসা শিক্ষার আরো সংস্কার প্রয়োজন।

ঘন ঘন সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন কোনোভাবে সুফল বয়ে আনে না। আমরা এমন এক জাতি, অন্যদের অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পছন্দ করি। নিজের স্বকীয়তা পরিত্যাগ করতে সময় লাগে না। আমাদের শিক্ষায় বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকের শাসনকে নিকট অতীতে কেউ কোনোদিন খারাপ চোখে দেখেনি। এখন আমরা ইউরোপ, আমেরিকার অনুসরণে শিক্ষকের শাসন রহিত করেছি। আমাদের পরিবেশ ও পারিপার্শিকতা এবং সুযোগ-সুবিধা তাদের মতো নয়। তাদের একটি শ্রেণিতে কুড়ি পঁচিশজন মাত্র শিক্ষার্থী থাকে। এদের জন্য এক সাথে দুজন শিক্ষক থাকেন। একজন মুল শিক্ষক অন্যজন সহযোগী। সেই তুলনায় আমাদের শ্রেণিকক্ষের আয়তন অনেক বড়। একজন শিক্ষকের পক্ষে পুরো শ্রেণি সামাল দেয়া কঠিন। আমরা ছোটবেলায় শিক্ষকের যুগপৎ শাসন ও সোহাগে লেখাপড়া করেছি। আজ শিক্ষকের শাসনের অধিকার কেড়ে নেয়ায় লেখাপড়া শিকেয় উঠেছে। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে পড়ালেখার গরজ বোধ করে না। ইউরোপ-আমেরিকার স্টাইলে মুল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে কী ফল আমরা পেয়েছি? নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পদ্ধতি, সৃজনশীল পরীক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কী সুফল দিয়েছে? এতে পরীক্ষায় পাশের হার বেড়েছে। পড়ার মান বাড়েনি, বরং কমেছে। এ জাতীয় নানা অসংগতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষায় যে রকম ইতিহাস বিকৃতি হয়, মনে হয় পৃথিবীর আর কোথাও সেরকম ইতিহাস বিকৃতির নজির নেই। এখানে যারা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, তখন তারা তাদের মত করে ইতিহাস তৈরি করে। প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত ইতিহাসের নিচে চাপা পড়ে যায়। ফলে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত থাকে। মিথ্যে ইতিহাস চর্চার কারণে দেশ ও জাতি আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলে। ’৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিরাট স্মারক। এটির ইতিহাস নিয়েও সময়ে সময়ে নানা তর্ক বিতর্কের সুচনা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যে যার মতন করে লেখেন। আমাদের লেখক, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবিরাও এই হীনমন্যতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। এসবের অবসান ঘটিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চৌকস ও দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে চাইলে একটি স্থায়ী ও নিরপেক্ষ শিক্ষা কমিশন গঠন করা একান্ত অপরিহার্য। এই কমিশনের এমন একটি কাঠামো হওয়া চাই, যাতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন শিক্ষার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়। আরেকটি ছোটখাটো বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করে আজকের লেখাটি এখানে শেষ করতে চাই। আমাদের এসএসসি পাস এমনকি সপ্তম-অষ্টম পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভালো পড়তে ও লেখতে পারে। কিন্তু বিএ কিংবা এমএ পাস ছেলেমেয়েরাও ভালো ইংরেজি বলতে পারে না। তারা যাতে সুন্দর ও সাবলিল ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে, সেই বিষয়টি আমাদের নতুন প্রজন্মকে রপ্ত করার পথ সকলে মিলে বের করে দিতে দেবে। সেই কৌশলটি আমাদের শিক্ষায় থাকা চাই। ভারত কিংবা পাকিস্তানের একজন মাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলে বা মেয়ে যদি ইংরেজি অনর্গল বলতে পারে, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা কেনো পারবে না? আমাদের শিক্ষা থেকে এই দীনতা ঘোচাতে হবে। তা না হলে ইউরোপ এবং আমেরিকার দেশে গিয়ে আমাদের সন্তানেরা খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না। সে সব দেশে ইংরেজি পড়া কিংবা লেখার চেয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারার গুরুত্ব অনেক বেশি।

 

জনপ্রিয়