
আজ ৬ মার্চ, ‘জাতীয় পাট দিবস’। পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। স্বাধীনতার পরে ও আগের সময়টাতে পাট ছিলো বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিযোগ্য ফসল। বিশ্বে বাংলাদেশের পাটের কদর ছিলো ব্যাপক। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এগোচ্ছিলো পাটকে কেন্দ্র করে। ষাট এর দশকে অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় পাট ও পাটজাত পণ্য। বাংলাদেশের জমি ও আবহাওয়া, কৃষকদের উদ্দীপনা আর জনসাধারণের সম্পৃক্ততায় পাট শিল্প এগিয়ে যেতে থাকে স্বমহিমায়।
এর শুরুটা হয় ১৯৫০ এর দশকে। কিন্তু অতীতের সেই সোনালি জৌলুশ হারিয়ে পাট শিল্প এখন ধুঁকছে! সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় পাটের আজকের এই দৈন্যদশা। সরকারি খাতের বহু পাটকল লোকসানের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদিও বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক বাজারে পাটজাত পণ্যের রপ্তানির মাধ্যমে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে।
তথ্য মতে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলের সংখ্যা ছিলো ৭৭টি। বর্তমানে রাষ্ট্রের অধীনে পাটকলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬টি। এর বেশিরভাগ আবার বন্ধ। বেসরকারি খাতে বর্তমানে পাটকলের সংখ্যা ২৭২টি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৭০টির মতো পাটকল বর্তমানে উৎপাদনে আছে। পাকিস্তান আমলে সরকারি পাটকলগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিলো।
কিছু কিছু পাটকলের সূচনাকাল আরো আগে। পাট মূলত বর্ষাকালীন ফসল। সাদা ও তোষা পাট নামে বাংলাদেশে দুই ধরনের পাট দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে যতো পাট জন্মে বাংলাদেশ তার মাত্র ২৮ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। তবে গুণে ও মানে বাংলাদেশের পাট সেরা। পাট উৎপাদনে একসময় বাংলাদেশ এক নম্বরে ছিলো। কিন্তু সময়োযোগী পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে বাংলাদেশ পাট উৎপাদনে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশের রংপুর, ফরিদপুর, যশোর ও কুষ্টিয়ায় সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদন হয়। বর্তমানে দেশের ৭ থেকে ৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়।
প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু ৯০ এর দশকে বাংলাদেশে ১২ লাখের বেশি হেক্টর জমিতে পাটের চাষ করা হতো। বাংলাদেশ মূলত কাঁচা পাট ও পাট জাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। প্রতিবছর সবমিলিয়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করা হয়। পাটের দেশ হিসেবে বিশ্ববাজারে যেখানে বাংলাদেশের পাটের আধিপত্য থাকার কথা সেখানে আধিপত্য করছে ভারত। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ও রপ্তানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। কোনো কোনো বছরগুলোতে ভারতে উৎপাদন বেশি হলেও রপ্তানিতে বাংলাদেশ সবসময় ভালো অবস্থানে ছিলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ছিলো প্রায় ১৪ লাখ টন। আর একই অর্থবছরে ভারতের উৎপাদন ছিলো প্রায় ১০ লাখ টন।
গত চার দশক ধরে পাট শিল্পকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিলো সেভাবে নেয়া হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি পাটকলগুলো তিলে তিলে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই ২৬টি রাষ্ট্রয়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে পাটকলগুলো খুলে দেয়ার আশ্বাস দিলেও সে আশ্বাস আর আলোর মুখ দেখেনি। শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করেই বন্ধ হয়ে যায় দেশের সবচেয়ে দামি পরিবেশবান্ধব শিল্পের দুয়ার। দুঃখের বিষয় হলো, তখন শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করলেও পাট শিল্পের কর্মকর্তাদের বেতন প্রতিমাসে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পাটকলগুলোতে বিনিয়োগের অভাব, যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন না করা, দক্ষ স্পিনার ও তাঁতির অভাব, বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের বহুমুখী চাহিদার ওপর গুরুত্ব না দেয়া, ভেজা পাট কেনায় যোগসাজশ, পাটকল পরিচালনা ও বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম, সঠিক মৌসুমে পাট কেনায় বরাদ্দ না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের পাট শিল্পের সোনালি দিন ‘কালো দিনে’ রূপান্তর হয়। পাটশিল্পগুলো বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিলেই যে বাঁচানো সম্ভব হবে-সেটা বিবেচনা করাও ভুল ছিলো। কেনোনা যে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতে পাটকল ছাড়া হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য কী, সেটা জানা আগে দরকার ছিলো। একটা সময় সরকার কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনতো। যদিও তার পরিমাণ ছিলো ৭ থেকে ৮ শতাংশ। সরকারিভাবে পাট দেরিতে কেনার ফলে চাষিরা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছে পাট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতো। সরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে চাষিরা সঠিক দাম থেকে বঞ্চিত হয়। সিন্ডিকেটদের দখলে চলে যায় পাটের বাজার। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হয় পাটশিল্পের উন্নয়নে। কিন্তু শ্রমিক কমানো, বেসরকারিকরণ বাড়ানো, শ্রমিকদের মজুরি না বাড়ানোর মতো শর্তের বেড়াজালে উন্নয়নের বদলে তা পাটশিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভর্তুকি কমানোও ছিলো পাট শিল্প ধ্বংসের আরেকটি কারণ।
পাটের মতো পরিবেশবান্ধব শিল্পকে ধ্বংস করার ফলে গত তিন দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্তহারে বেড়েছে। বেড়েছে পরিবেশের ক্ষতি। প্লাস্টিক-পলিথিনের দূষণ ঠেকাতে সরকার এখন উঠেপড়ে লেগেছে। কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তখন যদি পাট শিল্পকে ধ্বংস করা না হতো, উৎপাদন ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া হতো তাহলে পাট শিল্পও বাঁচতো আবার দূষণ রোধ করাও সম্ভব হতো।
পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে। গাড়ি নির্মাণ, কম্পিউটারের বডি নির্মাণ, উড়োজাহাজের পার্টস তৈরি, খেলাধুলার বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করা হচ্ছে পাট দিয়ে। পাটকাঠি থেকে তৈরি চারকোল দিয়ে বহু জিনিস তৈরি করা হচ্ছে। পাটের তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, পাপোশ, জুতা, সুতা, কামিজসহ অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে। পাট শাকেরও চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। পাট গাছের পাতা দিয়ে অর্গানিক চাও তৈরি হচ্ছে। পাট শিল্পের থেমে যাওয়ার সুযোগে স্থান নিয়েছে প্লাস্টিক ও পলিথিন। আজ প্লাস্টিক শিল্প যেভাবে এগিয়েছে সেভাবেই এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো পাট শিল্পের।
বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারে নিরূৎসাহিত করা হচ্ছে। পাট শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার সময় এখনই। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ৬টি ও ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ১১টি মিলিয়ে মোট ১৭টি পণ্যের পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক ব্যবহারে আইন থাকলেও অনেকেই তা মানেন না। ঠিক পলিথিন ব্যবহারের মতো। নিষিদ্ধ পলিথিন সবার হাতে হাতে থাকার মতো অবস্থা! তাই পাট শিল্প রক্ষায় পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। যাহোক বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশবান্ধব পণ্য পাটের চাহিদা বাড়বে বৈকি কমবে না। পাটশিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। একসময় পাট যেভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতো সেই সময়কে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি উদ্যোগে পাটকলগুলো খুলে দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। লোকসান ও বিপর্যয়ের সব কারণ দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাট শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে পাট বাঁচলে কৃষক বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে, শিল্পের প্রসার হবে সর্বোপরি বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষক