ঢাকা রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫ , ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

আস্থার সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা

মতামত

জাকির আহমদ খান কামাল, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৭ মার্চ ২০২৫

আপডেট: ১২:৫৬, ৭ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

আস্থার সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা

আমরা জানি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার ন্যায় শিক্ষাও মানুষের মৌলিক চাহিদা। শিক্ষা অর্জনের জন্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থলোতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, জ্ঞান অন্বেষণ প্রতিটি নর-নারী জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।

মানুষের মৌলিক চাহিদা, অধিকার, মর্যাদা ও সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের নাগরিকদের নিজ দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে উৎপাদনক্ষম করে গড়ে তোলা জরুরি। এ ধরনের সুনাগরিক তৈরির প্রধানতম উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের একটি জন্মগত অধিকার, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার।

সেই দিক বিবেচনায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংক্রান্ত আটটি বিষয় নিয়ে শতাধিক প্রধান ও আনুষঙ্গিক সুপারিশ প্রদান করেছেন।

বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় এবং প্রত্যন্ত চঞ্চলসহ দেশের ১১টি জেলা  এবং ১২ টি উপজেলা সরে জমিনে পরিদর্শন করে কমিটি সুপারিশ মালা তৈরি করেছেন। কার্যক্রম গুলোকে অতিদ্রুত,  স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদে করণীয় হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। সুপারিশ তৈরিতে দুটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছে:

১. নানা উদ্যোগ সত্বেও শিখন-মানের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তা দূর করা।

২. শিশুর শিখন, কল্যাণ ও নিরাপত্তাকে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে স্থাপন করা।

যে প্রধান আটটি বিষয় চিহ্নিত করে সুপারিশ প্রণীত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে:

১. শিক্ষক-শিখন ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন।

২. শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী

৩. অভিগম্যতা, অন্তর্ভুক্তি ও বৈষম্য নিরসন।

৪. প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষা ও শিশুর বিকাশ।

৫. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাওবিদ্যালয়-বহির্ভূত শিশু।

৬. শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা।

৭. ক্ষেত্রনির্বিশেষে ক্রস-কাটিং বিষয়।

৮. সংস্কারবাস্তবায়ন, অর্থায়ন ও পরবর্তী পদক্ষেপ।

 এ প্রবন্ধে শুধু প্রাথমিক শিক্ষায় স্থবিরতা নিয়ে কিছু উপস্থাপনার প্রয়াস। সর্বশেষ তথ্যঅনুযায়ী দেশজুড়ে ৬৫ হাজার ৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদানে নিয়োজিত। এতে ৩, লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন শিক্ষক, ২ কোটি ৯ লাখ ১৯ হাজার ২০১ জন শিক্ষার্থীকে  পাঠদান করছেন। কিন্তু এর বাইরে শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কাওমি মাদরাসার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৮ লাখ ৩২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। আবার ২৩ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় কি পরিমাণ শিক্ষার্থী কমেছে তার প্রতিবেদন এখনো তৈরি হয়নি তবে এ সময় কিন্ডারগার্টেন  প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার,  মাদরাসায় ৩৬ হাজার  শিক্ষার্থী বেড়েছে বলে জানা যায় বিদায়ী বছরের মাঝামাঝি তৈরি প্রতিবেদনে।

 শিক্ষাদানের মূল কেন্দ্র হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর তার পাশ ঘিরে আছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী অভিভাবক ও অন্যান্য অংশীজন। প্রত্যেকের অবস্থান থেকে তার সমস্যা গুল চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারলেই কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে স্থবিরতা দূর করা সম্ভব।

 পরামর্শ কমিটি পর্যালোচনা ও সুপারিশ তৈরিতে প্রথম যে বিষয়টি বিবেচনায় আনার কথা বলেছেন তা হলো নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও শিখন মানের ক্ষেত্রে স্থবিরতা দূর করা। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় স্তবিরতার অন্যতম কারণ হলো শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি।

আবার অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ মাদরাসায় ভর্তি। মাদরাসায় ভর্তির জন্য বছরের শ্রুতিমধুর বিজ্ঞাপন মাইকে আহ্বান ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়ে এমন ধারণা দেয়া হয় যেনো মাদরাসায় সন্তানদের ভর্তি করলেই দুনিয়া ও আখেরাতের হিসাব সহজ হয়ে যাবে। তা ছাড়া করোনাকালীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো না। মাদরাসার কোনো শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়নি। এমন ধারণায় অভিভাবকরা মনে করেন মাদরাসা শিক্ষায় নিরাপদ ইহকাল এবং পরকালেও কল্যাণ বয়ে আনবে। ধর্মীয় মহাসমাবেশেও আলেম ওলামারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তির ব্যপারে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে।

এ প্রশ্নে বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, শিক্ষকদেরও দায়িত্ব অভিভাবকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাবলে তাদেরকে বিদ্যালয়ে আসতে উদ্ভুদ্ধ করা। এটাতো একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করানো ছাড়া আর কিছুই না। এর জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি।

সরকারি বিধান অনুযায়ী দুই কিলোমিটার পরপর প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের নিয়ম থাকলেও এরকম কোনো বিধি-বিধান মাদরাসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে নেই। একই বিল্ডিং এ একাধিক মাদরাসা অহরহ দেখা যায় মফস্বল শহরসহ গ্রাম গঞ্জেও। শিক্ষা স্থবিরতা দূর করতে প্রথমেই মাদরাসা স্থাপনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন তৈরি করা উচিত বলে মনে করি। সেই সঙ্গে পাঠ্যবিষয় নির্বাচনেও সমন্বয় সাধন করতে হবে।

প্রাথমিকের অনেক শিক্ষক তাদের সন্তানকে কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসহ বিভিন্ন প্রাইভেট স্কুলে পড়াচ্ছেন যা আদৌ কাম্য নয়। এ বিষয়ে অভিযোগ করে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে কেনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াবেন বলে প্রশ্ন তোলেন। শুধু তাই নয় অনেক প্রাথমিক শিক্ষকও সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকেন। তা ছাড়া প্রাথমিকের সিলেবাস ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকের অভিমত হলো তারা শিক্ষা দানের মূলভিত্তি হলেও বেতন কাঠামো এতটাই দু্র্বল যে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পারিবারিক ব্যায় মিটিয়ে নিজের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে শ্রেণিপাঠদানে যত্নশীল হওয়া শুধু কষ্টসাধ্য নয় দুরূহও বটে।

গ্রামের সাধারণ অভিভাবক শিক্ষার ব্যপারে অনেকটাই সচেতন। তারা এখন ভাবতে শিখেছে শিক্ষার প্রয়োজনে সন্তানের জন্য ব্যায় করা উত্তম বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া যেমন লাভ হয় না তেমনিভাবে লেখা পড়ার জন্য ব্যায় না করলে লেখা পড়া হবে না। তারা মনে করে যে বিদ্যালয়ে মাসিক বেতন, পরীক্ষা ও পরীক্ষার  ফি  যতো বেশি সে বিদ্যালয় ততো ভালো। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করবে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা। যে কারণে সচ্ছল পরিবার তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনিহা প্রকাশ করে।

ফেসবুক সর্বস্ব বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষক সংগটনগুলো অভিন্ন ও ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে নিজস্ব আঙিনা থেকে আন্দোলনের মাঠে আছে। সর্বশেষ সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের ন্যায্য দাবিটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কাদা ছোড়াছুড়ি লেগেই আছে। শিক্ষক নেতারা কোনো একটা দাবি নিয়ে ঐক্যে পৌঁছাতে ব্যার্থ। তৈরি হচ্ছে একে অপরের প্রতি আস্থার সংকট। সেই সঙ্গে হচ্ছে শ্রেণিতে পাঠদান ব্যাহত। দশম গ্রেডকে শুধুই বেতন-স্কেলের ফ্রেমে দেখলে ঠিক হবে না। এ দাবি  শিক্ষকদের মর্যাদার। থার্ড ক্লাস থেকে সেকেন্ড ক্লাস পরবর্তীতে ফার্স্ট ক্লাস।

সহকারী শিক্ষকদের ভাবনা এ দাবি তাদের। অপরদিকে, প্রধান শিক্ষকদের ভাবনা এ দাবি সহকারীদের। আসলে এ দাবি শিক্ষক সমাজের মর্যদার দাবি প্রাথমিক শিক্ষায় সব অংশীজনের। এ পরিস্থিতি প্রধান ও সহকারীদের হীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। সময় এসেছে ঐক্যের, অন্যথায় আরো খারাপ অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের সামনে অবস্থান করছে।

 বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় স্থবিরতার আরো একটি কারণ মামলাজট। সরকারের এ বিভাগটি সবচেয়ে বেশি মামলা জটে ভারাক্রান্ত। তার বেশিরভাগ মামলাই শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। ফলে মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে। বর্তমান সরকারের প্রতি পরামর্শ থাকবে শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও আর্থিক বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সম্মানজনক সমাধান করা। একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগকে মামলাজট মুক্ত করে শিক্ষকদের আস্থার সংকট কাটিয়ে শিক্ষাদানের কাজে মনোনিবেশের আহ্বান জানানো।

লেখক: শিক্ষক 

জনপ্রিয়