
যখন দেশের কথা ভাবি, বা কোথাও যদি আলোচনা হয়, অনেকগুলো ভাবনার ভিড়ে একটু আশস্ত হই, সরকার তো আছে! রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করার জন্য ওনাদের মতো জ্ঞানী ব্যাক্তি আর কেইবা আছেন! যেকোনো সমস্যার একটা সুন্দর সমাধান নিশ্চয়ই বের করে আনবেন। আমাদের দেশে আদতে তাই হয় ও হয়ে আসছে এবং আগামীতে ও তাই হবে। যেমন- ধরুন, আমরা আমাদের মুল্যবান মতামত দেয়ার মাধ্যমে একজন আইনপ্রণেতা নির্বাচন করি। উনি এলাকার বিভিন্ন সমস্যা, আমাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সর্বোচ্চ মহলে, ফোরামে আলাপ আলোচনা করেন।
ওনার মতো উন্নয়নকামী লোক আর নিশ্চয়ই আর সে এলাকায় নেই। তবে অনেকগুলো ভালো কাজের মধ্যে তিনি একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেন, উনি যতোদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততোদিন এমনই হতে থাকবে। নিজের বড় ভাই এমপি, তারপরের ভাই উপজেলার চেয়ারম্যান, তারপরের ভাই সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তারপরের ভাই সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, তার চাচাতো-মামাতো-খালাতো ভাইবোন চাচা, মামা, খালা, মোটকথা তার পরিবারের বাইরে আর কোনো মানুষ নেই, যারা দায়িত্ববান বা কোনো ভালো কাজে সম্পৃক্ত হতে পারেন।
যাকে স্কুলে পড়া না পারার কারণে, স্কুলে না আসার কারণে, স্কুলে আসার পথে মেয়েদের কটূক্তি করার কারণে, মদ, গাঁজা, ভাঙ, আফিম, হেরোইন, ইয়াবা খাওয়ার কারণে হেডমাস্টার বেঞ্চের পায়া ভেঙে মারতে মারতে স্কুল থেকে বের করে দিলেন তিনিই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে নির্বাচিত করার জন্য হেডমস্টার উঠেপড়ে লেগেছেন। স্কুলের কক্ষ সংস্কার থেকে শুরু করে, বই বিক্রি, গাছ বিক্রি, ছাত্র-ছাত্রীর উপবৃত্তির টাকা বিকাশে নিজেদের নম্বরে নেয়া, প্রতিবদ্ধী ভাতাসহ সহকর্মীদের ওপর বিশেষ খবরদারি, তাদের হেয় করা, হেনস্তা করা ইদ্যাদি। কোনো কাজ তারা বাদ রাখেননি।
স্কুলের উন্নয়নে তারা পারলে পুরো স্কুলটা বিক্রি করে দিতে চায়। অশিক্ষিত ‘ক’ লিখতে যার কলম ভাঙে, সে মানুষটা স্কুলে আসলে তাকে নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষা ধ্বংস করার আর একটা কুট পরিকল্পনা করে। ফলে যা হবার তাই হলো। শিক্ষা কোমায়, সভাপতি আত্মগোপনে, আর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের গলায় উঠলো জুতোর মালা। পেছন থেকে আওয়াজ সংস্কার চাই। কিন্তু কী দেখলাম। কোমল শিশু শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সমুন্নত রাখতে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিক্ষাকে নির্বাসনে দেয়া হলো।
কর্তৃত্ববাদী শাসনের আপাত অবসানের পর সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র সংস্কারের কথা উঠেছে। শিক্ষাক্ষেত্র ও তার ব্যতিক্রম নয়। বিগত বছরগুলোয় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন উপলব্ধি থেকেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১২ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এই শিক্ষাব্যবস্থাটি পথে আনতে একটু দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমকে ফলদায়ক ও টেকসই করার জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং যৌক্তিকভাবে এটিকে এগিয়ে নেয়া এই সময়ের চ্যালেঞ্জ।
সংস্কারের দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অর্ন্তবর্তী সরকার। সংবিধান, বিচার, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শ্রম, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। এখানে শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক কোনো কমিশনের উল্লেখ নেই। তাহলে কি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই?
এসজিডির লক্ষ্যমাত্রা-৪ অর্জন করতে হলে বিশেষজ্ঞদের মত হলো-১. মানসম্মত শিক্ষক সংখ্যা বাড়াতে হবে। ২. যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে ৩. মানসম্মত বই ও শিখন সামগ্রী সরবরাহ ও ব্যবহার করতে হবে। ৪. শিখন-শেখানো পদ্ধতির ও কৌশলের কার্যকর ব্যবহার করতে হবে। ৫. নিরাপদ ও সহযোগিতামূলক শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ৬. উপযুক্ত ও সঠিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা করতে হবে। ৭. আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক সুসম্পর্ক রাখতে হবে। ৮. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্যে সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। ১০ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বান্ধব শিখন পরিবেশ সমুন্নত রাখা।
দুর্নীতি শরীরের রক্তের মতো শিক্ষাব্যবস্থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে। এক দুই মাস বা এক দুই বছরে এর সংস্কার সম্ভব নয়। কেনোনা সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে কিছু প্রধান প্রধান বিষয়গুলো আমাদের সংস্কারের কাজ হাতে নিতে পারি।
১. প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদরাস ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এর সু-সমন্বিত পরিচালনার জন্য দুটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে একটি মন্ত্রণালয় তৈরি করা প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগগুলো হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ (প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত), মাধ্যমিক বিভাগ (চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি), উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) ও উচ্চশিক্ষা। কারিগরি শিক্ষার জন্য আলাদা বিভাগ থাকবে। সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
২. একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার। আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষক এবং শিক্ষা প্রশাসকদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হতে হবে। এর কাজ হবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নজর রাখা, প্রতিনিয়ত শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষনা কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া। মন্ত্রণালয় কমিশনের পরামর্শকে সম্মান দেবে।
৩. একটি শিক্ষা গবেষণা পরিষদ গঠন করা প্রয়োজন। এই পরিষদ মন্ত্রণালয় ও কমিশনের কাছ থেকে গবেষণার ইস্যু নেবে। তারপর ইস্যুভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ বিধি অনুসারে সেখানে অংশ নেবে। অভিজ্ঞ প্রস্তাবকারী অগ্রাধিকার পাবে সেখানে। গবেষণার উচ্চমান রক্ষার্থে যা যা করণীয়, পরিষদ তাই করবে। এর ফলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পরিমার্জনে গবেষণা ভিত্তি জোরালো হবে এবং দেশে শিক্ষা গবেষণার মান উন্নত হবে।
৪. স্বাধীন অবলোকন বিভাগ গঠন করা প্রয়োজন। প্রতিটিা জেলায় একটা দল থাকবে। রুটিন করে জেলার প্রতিটিা স্কুলকে অবলোকনের আওতায় আনতে হবে। প্রতি কোয়ার্টারে সেটা প্রকাশ করতে হবে এবং সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর সঙ্গে অন্য আর একটা কাজ করা প্রয়োজন, জেলা, উপজেলা ও প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কার কি দায়িত্ব সেটাও অবলোকনের আওতায় আনতে হবে।
৫. শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশন করা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে আমাদের এখনো অনেক ঘাটতি আছে। নিয়মিত প্রশিক্ষনের মধ্যে সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে এর আওতায় আনতে হবে। প্রতিষ্ঠান তার নিজের কাজ নিজে করবে।
৬. সেফ কাউন্টার ও তদন্ত বিভাগের মতো একটা স্বাধীন জোন তৈরি করা দরকার। আমরা দেখেছি নিজে দুর্নীতি করে সব শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু কেউ যদি একটা ভালো কাজ করে তার পেছনে সবাই লেগে যায়। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং বিচার প্রার্থীকে সঠিক বিচার পেতে সহযোগিতা করতে হবে।
কিন্তু একটা কথা না বললে নয়, শিক্ষা, শিক্ষক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপঠে শুধু বঞ্চনা, বঞ্চিত, লাঞ্চনার শিকারে পরিনত হয়ে গেলো! একজন ভিখারি ভিক্ষে করে বাড়ি বাড়ি করার কথা শুনি, কিন্ত স্কুলের শিক্ষকরা ১৭ হাজার ৫ শত টাকা পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য কি অবিরাম সংগ্রাম করে চলা! শিক্ষককে যদি শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নিতে হয়, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যতো বাজেট প্ল্যান পরিকল্পনা করি না কেনো কোনো কাজে আসবে না, যতোদিন না তাদের নায্য সম্মানী না দেয়া যাবে।
আমরা শুধু শিক্ষা সংস্কারের কথা বলি। কিন্তু শিক্ষার ধ্বংসের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সংস্কার দরকার সবার আগে। এদেশে জাড়ুদার কখন শিক্ষক হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখন উচ্চমান সনদ প্রদানের কারখানা হয়, ড্রাইভার কখন সরকারী সের্বোচ্চ চাকরি দাতা হয়, বোঝা বড় কঠিন! দোষীদেরকে সঠিক বিচারের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের শিক্ষা আমাদের অহংকার।
লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত