
প্রয়াত সমাজ সংস্কারক এবং সংবিধান ও আইনআদালত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ লেখক মিজানুর রহমান খান এর একটি প্রশ্ন সময়ের সীমা অতিক্রম করে চিরায়ত সত্য হয়ে ফুটে আছে। প্রশ্নটি হলো- ‘বলুন তো, র্যাবের কালো পোশাকের সঙ্গে গোখরো সাপের ফণার প্রতীক, এটা দেখে শিশুরা র্যাব হতে চাইবে? ভয় পাবে না? এটা কি বদলানোর কথা ভাববেন? অন্য দেশে?’ উত্তরটা ছিলো এমন, ‘এটা যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন। হয়তো আপনি যেভাবে ভাবছেন, সেটা তাঁরা চিন্তা করেননি। তাঁরা ভেবেছেন, সন্ত্রাসীদের জন্য এটা একটা বার্তা। অনেক দেশে বাঘ আছে, শ্বাপদের চিহ্ন অনেক স্পেশাল ফোর্সের আছে। হোলি আর্টিজানে হামলার পরে গঠিত স্পেশাল কমান্ডো গ্রুপের প্রতীক হলো অর্ধেক মানব, অর্ধেক নেকড়ে। নিরীহর কাছে তারা মানুষ, সন্ত্রাসীর কাছে তারাই নেকড়ে।’
উত্তরটা দিয়েছিলেন তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তার বিশেষ সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন মিজানুর রহমান খান। (প্রথম আলোতে প্রকাশ ১৮ মার্চ, ২০১৮।)
সামরিক বাহিনীকে যুক্ত করে বিশ্বের কোথাও এ রকম বাহিনী আছে কি? জনাব খানের এমন প্রশ্নের জবাবে বেনজীর বলেছিলেন- ‘না, এ ধরনের বাহিনী অনন্য।’ র্যাবের ওপর মানুষের আস্থার বিষয়ে বেনজীর দাবি করেছিলেন, ‘দেশ-বিদেশে সমীক্ষা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট বলেছে, র্যাবের ওপর ৮৩ ভাগ মানুষের আস্থা আছে।’ বেনজীরের ভাষায়, ‘বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড’ একটি ভুল শব্দ।
অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানাজাতের মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বেনজীর এখন বিদেশে ফেরার। আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও বেনজীরের জমানা এখন গত।
বর্তমানে আমরা আছি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জমানায়। এই জমানার হালহকিকত জানতে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেতে নজর দেই। গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনের শুরু এমন, “অপারেশন ডেভিল হান্ট-এর মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানের বসিলা ৪০ ফুট এলাকায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত হয়েছে দুইজন। মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘আগের মতোই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে’।”
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত পাঁচ মাস ২০ দিনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে সারা দেশে অন্তত ১৮ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে যৌথ বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ১২ জনের। হেফাজাতে যারা মারা গেছেন তারা ক্রস ফায়ার বা নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ১২ মাসে মারা গিয়েছিলেন ২১ জন।
মানবাধিকার কর্মী এবং গুম কমিশনের সদস্য নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা আবার ক্রস ফায়ারের বা বন্দুক যুদ্ধের সেই পুরনো গল্প শুনতে পাচ্ছি। একইভাবে আগের মতোই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। গত পাঁচ- সাড়ে পাঁচ মাসের যে চিত্র, তা মেনে নেয়া যায় না। এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এটা আমরা আশা করিনি। সরকার বলছে, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে, কিন্তু এর বিরুদ্ধে তারা এখনো কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি।’
৫ আগস্টের পর বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, জন প্রশাসন ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনসহ ডজনখানেক কমিশন হয়েছে। দুএকটি বাদে প্রায় সবগুলোরই সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে জমা পড়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও কাজ চলছে। র্যাব, পুলিশসহ কয়েকটি বাহিনীর নতুন পোশাক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলেছে কয়েকদিন। কিন্তু পোশাকের পোশাকি বদল আলোচনায় থাকলেও র্যাব ও স্পেশাল কমান্ডো এবং পুলিশ ব্যবহার করে গোখরো সাপ, নেকড়ে ও ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ ভুল শব্দই থেকে যাবে?