
শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করে পৃথিবীর মানুষ অতি ভোগবিলাসী জীবনযাপন করছে। আরাম-আয়েশের পাশাপাশি এর ফলে প্রতিনিয়ত বিরাট ক্ষতি বিদ্যমান। বর্জ্য ও বিষাক্ত ধাতুর সমস্যা এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সমস্যা। শিল্পবিপ্লব পরবর্তীতে প্রায় ২০০ বছর ধরে ইউরোপের দেশসমূহে উৎপাদনের চাকাকে সচল রাখতেই ব্যস্ত ছিলেন উদ্যোক্তারা।
শিল্পবিপ্লবকালীন ভয়াবহ দূষণ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় কলেবরে। সেসব শিল্পের কাঁচামাল যোগানোর জন্য এশিয়া ও আফ্রিকার শস্যক্ষেত্রগুলো অবিন্যস্ত ব্যবহারের কবলে পড়ে উৎপাদন শক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। প্রতিবেশ ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে ক্রমাগত। এটিই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো যেসব জটিল পরিবেশগত ও প্রাতিবেশিক ভঙ্গুরতার শিকার, তার অনেকগুলোরই শেকড় গাঁথা আছে উন্নত দেশগুলোর অতিভোগ ও অতিরঞ্জিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে।
খ্যাতিমান পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. জ্যোতির্ম্ময় সেন তার ‘প্রাকৃতিক ভূগোল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘বিগত কয়েক দশক থেকে স্ট্রটোস্ফিয়ারে ওজোন গ্যাসের হ্রাস এক বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কারণ, ওজোন গ্যাসের হ্রাসের সমস্যা এবং এর প্রতিকূল প্রভাব সমস্ত জীবজগতের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। বায়ুমণ্ডলে ওজোনের আস্তরণ পৃথিবীকে একটি নিরাপদ ছাতার মতো রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু ওজোনস্তরের হ্রাস পাওয়ার ফলে সমগ্র বায়ুমন্ডল বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে। বিজ্ঞানী ফারমেন ওজোনস্তরের এই অবয়ের নাম দিয়েছেন ওজোন হোল।’
‘ওজোন’ হচ্ছে তীব্র গন্ধযুক্ত হালকা নীল বর্ণের গ্যাসীয় পদার্থ। এটি একটি অস্থায়ী গ্যাস। ওজোন ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে ১০ থেকে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় ওজোনস্তর নামে অদৃশ্য এক বেষ্টনী তৈরি করে স্ট্রটোষ্ফিয়ারে অবস্থান করে থাকে। তবে ওজোন ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার উচ্চতায় সর্বাধিক মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। ওজোন মানবদেহের জন্য বিষাক্ত। কিন্তু স্ট্রটোষ্ফিয়ারে অবস্থানের কারণে পৃথিবীর প্রকৃতির ওপর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি মানুষের চোখে ধরা পড়ে না অথচ প্রাণী ও উদ্ভিদের পক্ষে এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। ওজোনস্তর এই ক্ষতিকর রশ্মির শতকরা ৯৯ ভাগই শোষণ করে। পৃথিবীপৃষ্ঠে এসে পৌঁছে মাত্র ১ শতাংশ। সূর্যের এই ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ওজোনস্তর আমাদেরকে রক্ষা করে পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ সূর্যের আলো উপহার দেয় এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে আসা তাপ মহাশূন্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে।
গৃহস্থালি পণ্য যেমন-ফ্রিজ, এয়ারকুলার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় একধরনের ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি) গ্যাস, যা শিল্প কারখানাতেও প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়, এই সিএফসি গ্যাস ওজোনস্তর য়ের অন্যতম কারণ।
ওজোনস্তর ক্ষয়ের ফলে বিশেষজ্ঞদের আশংকা হচ্ছে, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৃথিবীকে মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত করবে। সামগ্রিকভাবে তখন পৃথিবীর পরিবেশ বিপন্ন হবে। এতে করে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নিম্নভূমিতে প্লাবন, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আকস্মিক বন্যা, নদীভাঙন, খরা, সামদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রকট হয়ে দেখা দেবে। মানুষের ত্বকে ক্যানসার সৃষ্টি করে, অন্ধত্ব বৃদ্ধি করে, মানুষসহ সব প্রাণীর দেহের রোগ প্রতিরোধ মতা নষ্ট করে দেবে। উদ্ভিদের জীবকোষ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সমুদ্রের প্রাণীর সংখ্যা কমে যাবে। ফাইটোপ্ল্যাংকটনের উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। সামদ্রিক ও ভূ-পরিবেশের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইডের শোষণ কমে গিয়ে পৃথিবীতে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির এক তথ্যে দেখা যায়, ১ শতাংশ ওজোন গ্যাস হ্রাস পেলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১০ হাজার মানুষের ত্বকের ক্যানসারের বাড়তি ঘটনা ঘটবে। নাসার ধারণা মতে, দুই গোলার্ধেই ওজোনস্তর হ্রাস পাচ্ছে। ওজোনস্তর ক্ষয় অব্যাহত থাকলে ত্বকের ক্যানসার সাধারণ একটি রোগে পরিণত হবে, যা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর।
এই বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে, ওজোনস্তর রক্ষায় কানাডার মন্ট্রিলে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তৎপরতায় ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর ‘মন্ট্রিল প্রটোকল’ স্বারিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো, ওজোনস্তর ক্ষয়কারী বস্তু সামগ্রী ফেজ আউট করা। ইতোমধ্যে পৃথিবীর সব দেশ মন্ট্রিল প্রটোকল স্বার/অনুস্বার করেছে। ভবিষ্যতে হাইড্রোক্লোরোফ্লোরোকার্বন (এইচসিএফসি) ব্যবহার বন্ধ করার মাধ্যমে মন্ট্রিল প্রটোকল এর চুড়ান্ত বাস্তবায়ন নিশ্চিত সম্ভব হবে।
সিএফসি বা কার্বন নিঃসরণকারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমানোর জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন রকম কর্মসূচি এবং বাধ্যতামূলক কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনা কনভেনশনে। সেখানে উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার সীমিত করতে এবং বিকল্প যন্ত্রপাতি ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিলো। উন্নয়নশীল দেশেও কার্বন নিঃসরণকারী যন্ত্রপাতির বিকল্প ব্যবহার ও বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্ট্রিল প্রটোকলে বাংলাদেশসহ ৪৬টি দেশ ওজোনস্তর রক্ষার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে ২০৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী বস্তুগুলোর ব্যবহার বন্ধ করার কথা। কিন্তু ওজোনস্তর ক্ষয়কারী কার্বন নিঃসরণকারী বস্তুগুলোর ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। পৃথিবীতে সিএফসি উৎপাদন করে খুব কম দেশ, কিন্তু এর ব্যবহার হয় বিশ্বব্যাপী। মূলত শিল্পোন্নত দেশসমূহ সিএফসি’র শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবহার করে। তাই ওজোনস্তর রক্ষায় তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ওজোনস্তর রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সিএফসি ফেজ আউট করেছে এবং প্রটোকল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এইচসিএফসিও ফেজ আউট করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করা হয়েছিলো, ওষুধ শিল্প থেকে সিএফসি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ফেজ আউট করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশসহ সব রাষ্ট্রের পক্ষে এইচসিএফসি ফেজ আউট করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ এটি। কারণ, এইচসিএফসি শুধুমাত্র ওজোনস্তর ক্ষয়কারীই নয়, উচ্চমতা সম্পন্ন গ্রীণ হাউজ গ্যাসও বটে। এইচসিএফসি সফলভাবে ফেজ আউট করতে পারলে ওজোনস্তর রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতাও হ্রাস সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্যি এখন পর্যন্ত ফেজ আউট করা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ূ গবেষণা প্যানেল আইপিসিসি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। এ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এ পদক্ষেপ কার্যকর করতে রাজনীতিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি আবশ্যক। জাতিসংঘের উদ্যোগে স্পেনের ভেলেনসিয়া নগরে ইন্টারগর্ভনমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জর (আইপিসিসি) এক সম্মেলন শেষে বিশ্বের জলবায়ু সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।
ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হোয়াইট হাউজের পরিবেশ উপদেষ্টা আবহাওয়াবিদ জিম কনাফটন অবশ্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবহাওয়া বা পরিবেশ বিপর্যয়ের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞাটি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে বিশ্বব্যাপী যে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে তা কমানোর জন্য এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
আইপিসিসির ওই খসড়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২১২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অঞ্চল ভেদে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশংঙ্কা রয়েছে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে পৃথিবীর অনেক উপকূলীয় দেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়বে। চলতি শতাব্দির মাঝামাঝি ও শেষ দিকে যে আবহাওয়া বিপর্যয় ঘটবে তাতে এশিয়ার উপকূলীয় গরিব দেশের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিবেশ বিষয়ক কর্মশালার ষ্ট্যাভরস ডিমাস এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি একটি যুগান্তকারী প্রতিবেদন। যা বিশ্ব দুর্যোগ মোকাবিলায় দারুণ ভুমিকা রাখতে পারবে।
পৃথিবীতে প্রাণিজগতের আদর্শ পরিবেশের জন্য ওজোনস্তর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। যদিও ওজোনস্তর ক্ষয় এবং এইচসিএফসি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই নগণ্য, তবুও ওজোনস্তর রক্ষায় সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি সবার সচেতনতা প্রয়োজন। নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই দেখতে হবে, তা যেনো পরিবেশ বান্ধব হয় এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীর সুরক্ষার পাশাপাশি আমরা চাই এর একটি নির্মল আকাশ এবং তা যেনো বাস্তবেই হয় এই অঙ্গীকার আমাদের সবার।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক