
সদ্যবিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশনের কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা জানিয়েছেন। এর ফলে এখন পেনশনের তহবিলটি খুব সম্ভব শূন্যের কোটায় দাঁড়িয়েছে। এই দুঃসংবাদটি আমার মতো অবসরাধীন শিক্ষক-কর্মচারী, যারা চার পাঁচ বছর ধরে অবসরের টাকা হাতে পাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের ন্যায় চেয়ে আছেন, তাদের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো পড়েছে। গত আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পর কেনো জানি এ রকম একটি দুঃসংবাদের আশঙ্কা করেছিলাম। অবশেষে সাত মাস পর খবরটি শুনতে পেয়ে একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেলো। গল্পটির সারসংক্ষেপ এরকম: একদল ডাকাত একবার একটি ব্যাংক ডাকাতি করে। ডাকাত দল ব্যাংকের লকার ভেঙে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়ে যায়।
কিন্তু টাকা গুণে দেখেনি। এক সময় ব্যাংক ডাকাতির সব টাকা সর্দারের হাতে দিয়ে দেয়। এর কিছুদিন পূর্বে উক্ত ব্যাংকের অসাধু ম্যানেজার বিশ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এবার ডাকাতির পর ম্যানেজার আত্মসাৎকৃত টাকা হজম করার একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। ডাকাতির পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ম্যানেজার ডাকাতি হওয়া পঞ্চাশ লাখ টাকার সঙ্গে নিজের আত্মসাৎকৃত বিশ লাখ টাকা যোগ করে সত্তর লাখ টাকা ডাকাতির খবর ফলাও করে প্রচার করার ব্যবস্থা করে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেও সত্তর লাখ টাকা ডাকাতির বিষয়ে জানিয়ে দেয়। ডাকাত সর্দার ডাকাতিকৃত টাকার হিসাব আগে অন্য ডাকাতদের বলেনি। সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের পর সে প্রকৃত সত্য মানে পঞ্চাশ লাখ টাকা ডাকাতি করে পাওয়ার বিষয়টি অন্য ডাকাতদের বলে।
অন্য ডাকাতরা সর্দারের কথা বিশ্বাস না করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সত্তর লাখ টাকার ভাগ চায়। এ নিয়ে সর্দার ও অন্য ডাকাতদের মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার একপর্যায়ে একজন ডাকাতের ছুরির আঘাতে সর্দারের মৃত্যু হয়। এদিকে ম্যানেজার তার আত্মসাৎকৃত টাকা অবলীলায় হজম করে নেয়। আমাদের পেনশনের শত শত কোটি টাকা উক্ত গল্পের ডাকাত সর্দার ও ব্যাংক ম্যানেজারের খপ্পরে পড়ে নিঃশেষ হয়েছে কি না, সেরকম একটি প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। অবসর সুবিধা বোর্ডে আগে যারা ছিলেন তারাও টাকা খেয়েছেন এবং এখন যারা আছেন তারাও টাকা মেরেছেন। কারণ, এখানে কেবল ডাকাতের বসবাস। সব চোর আর ডাকাত! শিক্ষক-কর্মচারীর টাকা মেরে খেতে এদের জুড়ি নেই।
পেনশনের হাজারো কোটি টাকা লুটে নেবার সংবাদ প্রকাশ করার পরই শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিজের পদটি হারিয়ে ফেলেন। এ বিষয়ে টাকা মেরে খাওয়া চক্রটির হাত আছে বলে আমার মতো অনেক শিক্ষক আশঙ্কা করছেন। এ ধারণাটি একেবারে অমুলক নয়। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য নিরেট উপযুক্ত একজন উপদেষ্টা। অধিকন্তু, বিগত কয়েক মাসে তিনি আমাদের শিক্ষার ক্ষতগুলো এবং শিক্ষকদের দাবি দাওয়া সম্পর্কে অনেক কিছু অবগত হয়েছেন।
শিক্ষার ক্ষত এবং শিক্ষকদের সমস্যা দূরীকরণে তিনি ব্যক্তিগত কিছু নির্দেশের কথা জানিয়েছেন। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সরে যাবার কারণে তার নির্দেশনাগুলো আর কার্যকর হবার সুযোগ নেই। যেসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্থ করেছেন, সেগুলোও এখন অনিশ্চিত বলা চলে। এখন যিনি এসেছেন তিনিও খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ বটে। কিন্তু শিক্ষার ক্ষত ও শিক্ষকদের সমস্যাবলি অবহিত হতে তার আরো কয়েক মাস সময় লাগবে। নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও এসবের সমাধান খুঁজতে আরো অনেক সময় দরকার। একটি অন্তর্বর্তি সরকারের হাতে এতো বেশি সময় নেই। সুতরাং বর্তমান সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পরিবর্তন শিক্ষা এবং বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য নিঃসন্দেহে বড় দুঃসংবাদ বটে।
এবার অন্য কথায় আসি। জন্মাবধি শুনে আসছি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এটি কেবল কথার কথা নয়। চিরন্তন সত্য কথা বটে। কিন্তু আমাদের দেশে এই মেরুদণ্ডের পচন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। মেরুদণ্ডকে শক্ত কিংবা শক্তিশালী করার প্রয়াস নেই। এই সত্য কথাটি আজকাল যেনো কথার কথায় পরিণত হয়েছে। তা না হলে মেরুদণ্ড সোজা কিংবা শক্তিশালী করতে আমরা শিক্ষায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ কিংবা ব্যয় করতে কার্পণ্য করতাম না। ন্যূনতম পিছপা হতাম না।
শিক্ষার যারা চালিকাশক্তি, সেই শিক্ষকদের নিয়ে আমাদের কোনো রকম অবহেলা থাকতো না। বেতন কাঠামোর বিবেচনায় শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখার প্রশ্ন আসতো না। যেসব দেশে শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির নাগরিক গণ্য করে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, সেসব দেশের নাগরিকেরা প্রথম শ্রেণির মানুষ হতে পেরেছে। তারা যথার্থ মানবতা, মনুষত্ব ও মানবিক মুল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পেরেছে। দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর আমরা? আমাদের অনেকে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ হতে পারছি না। চেহারায় মানুষ হয়েছি ঠিকই। আচার-আচরণে সত্যিকারের মানুষ হতে পারিনি। দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে পারিনি।
বেকারত্বের বহর বাড়িয়ে চলেছি। এর কারণ খুঁজে বের করতে কোনো তৎপরতা নেই। কেবল লুটপাট করার ইচ্ছে। অন্যকে মেরে নিজে বড় লোক হবার খায়েশ। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আমাদের মধ্যে জন্মায়নি। দেশপ্রেমের নামে দেশকে লুটেপুটে খাওয়ার তৎপরতায় আমাদের সঙ্গে অন্য কেউ কুলিয়ে উঠতে পারে না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটে বিশ্বে মনে হয় আমাদের সমান আর কেউ নেই। উচ্চশিক্ষিত হয়েও এসব করতে আমাদের এতোটুকু বিবেকে আটকে না কেনো? শিক্ষায় যারা রক্ষক, তারাই ভক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ। সেই ছোটবেলা থেকে বাজেট বক্তৃতা এবং বাজেট পরবর্তী সংবাদপত্রে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দের কথা শুনে আসছি। কিন্তু, শিক্ষায় এতোটুকু গুণগত মানের পরিবর্তন হতে দেখিনি।
আমাদের শিক্ষার পঁচনটি একদম মাথা থেকে শুরু হয়েছে। সেই পচন রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেই। যেনতেন রকমের সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। যুগোপযোগি সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যবই প্রণয়নে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা দৃশ্যমান। এসবের নামে টাকা মেরে খাবার হরিলুট চলছে। যারা নীতিনির্ধারক, তাদের সন্তানেরা বিদেশের নামীদামি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগি সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যবই নিয়ে পড়ালেখা করে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সন্তানেরা বিপদে পড়েছে। এখানে পড়ালেখা করে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। চাকরি তো নেই-ই। নিজে থেকে কিছু করে জীবন চালিয়ে নেবার সুযোগও নেই। সেই ছোটবেলায় ‘কারিগরি শিক্ষা’ আর ‘বৃত্তিমুলক শিক্ষা’র কথা বাংলা ব্যাকরণের রচনা অংশে বহুবার মুখস্থ করেছি। কিন্তু, বাস্তবে এর কদাচিৎ দেখা পেয়েছি। আজও আমাদের শিক্ষায় বৃত্তিমুলক কিংবা কারিগরি শিক্ষা এবং সর্বশেষ আইসিটি শিক্ষার দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।
তাহলে আমাদের শিক্ষা কি করে জাতির মেরুদণ্ড হবে? যা তা পড়লেই সেটি শিক্ষা হয় না। যা মানবজীবনে কার্যকর ফল বয়ে আনে, তাই শিক্ষা। মানবজীবনের আচরণে ও চালচলনে যা কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্চিত পরিবর্তন সাধন করতে পারে না, তা শিক্ষা নয়। আমাদের শিক্ষা এসব কতোটুকু করতে পেরেছে কিংবা কেনো পারছে না, সেটি যাচাই করে দেখার এখনই সময়। আজকাল লেখাপড়া থেকে অনেক অভিভাবক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। টুকটাক দু-চার ক্লাস পড়িয়ে ছেলেদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচতে এখন অনেকে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায় না। উচ্চশিক্ষিত হয়ে কী করবে? অনার্স-মাস্টার্স পাস করেও প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয় না। হলেই বা কী হবে? শিক্ষকতায বেতন আর কয় টাকা? এখন শিক্ষকতার চেয়ে কেরানির চাকরি অনেকের পছন্দ। একজন কেরানি প্রতিমাসে বেতনের সঙ্গে সরকারি নিয়মে প্রতিমাসে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পায়। বছরে দুটো পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা পায়। কিন্তু, বেসরকারি শিক্ষকের বেলায় তাও জোটে না। কখনো বা চাইতে গিয়ে পুলিশের অত্যাচারের শিকার হতে হয়।
আমাদের এখানে মুখে আর বই পুস্তকে শিক্ষকদের যতোসব মর্যাদা! কাজের বেলায় কিছুই নেই। গত কয়েকদিন আগে প্রাথমিকের নিয়োগ বঞ্চিত শিক্ষকদের দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের হাতে মার খেতে দেখেছি। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস আর সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার দাবিতে বিগত প্রায় বিশ-পঁচিশ দিন ধরে ঢাকার রাস্তায পড়ে থাকতে দেখেছি। দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে যেতে চাইলে পুলিশ যেতে দেয়নি। সচিবালয়ে যেতে চাইলেও পুলিশ বাঁধা দেয়। শিক্ষকদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয়, পুলিশ সেটিও জানে না। এ দেশে পুলিশের চরিত্র কবে পরিবর্তন হবে, সেটি কেবল আল্লাহ জানেন। পুলিশের কথা না হয় বাদই দিলাম। সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের বিবেকটা কেমন? রোজার মাসে এই সময়ে শিক্ষকেরা সাহরি ও ইফতার কোথায় করবেন, সেই চিন্তাটি একবারও এদের মাথায় আসেনি।
চিন্তাটি মাথায় এলে অন্তত সরকারকে বলে কয়ে শতভাগ উৎসব ভাতার আশ্বাস পাইয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বাড়ি ফিরে যাবার ব্যবস্থাটি করে দিতে পারতো। যাই হোক, সর্বশেষ সদ্যবিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষকদের কিছু দাবি-দাওয়ার বিষয়ে মনে হয় সামান্য আশ্বাসের ইঙ্গিত দিয়েছে। সেই আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে বিশ-পঁচিশ দিন পর একরকম খালি হাতে শিক্ষকরা বাড়ি ফিরে গেছেন। রোজার মাসে খেয়ে না খেয়ে আর কতো আন্দোলন করা যায়? এভাবে শিক্ষকদের কতো খণ্ডিত আন্দোলন মাঠে মরে যেতে দেখেছি।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কোনোদিন ব্যর্থ হয়নি। ব্যর্থ হতে পারে না। শিক্ষকদের বিভাজিত আন্দোলন দেখতে চাই না। চাই সম্মিলিত ও সমন্বিত শিক্ষক আন্দোলন। এতে করে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান যেমন বাড়বে, তেমনি শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া পুরণ করতে যেকোনো সরকার বাধ্য হবে। হোক সে রাজনৈতিক কিংবা অন্তর্বর্তী যেকোনো ধরনের সরকার। শিক্ষায় সুদিনের অপেক্ষায় আজ তাই এখানেই শেষ করছি। এই বিশেষ ধরনের সরকারের হাতে শিক্ষার সব অসংগতি আর শিক্ষকদের সব দুর্গতির চির অবসান হোক।
লেখক: আবাসিক প্রতিনিধি, আমাদের বার্তা, লন্ডন