
১৪ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস’। নদী রক্ষায় নদীর প্রতি দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিতেই ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরের এক সমাবেশ থেকে এ দিবসের ঘোষণা দেয়া হয়। নদীর জীবন আছে। জীবন আছে বলেই এই নদী আমাদের সেচ ব্যবস্থা, যাতায়াত, মৎস্য উৎপাদন, পানি সরবরাহ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।
সময়ের পরিক্রমায় নদীর প্রাকৃতিক গঠনগত পরিবর্তন, কম পানি প্রাপ্তি, দখল, দূষণ আর ভরাটের কারণে দেশের নদ-নদীর অবস্থা বেহাল। দখল-দূষণের সঙ্গে পলিচাপা পড়ে দম বন্ধ হয়ে নদীগুলো মারা যাচ্ছে! দেশের কোনো কোনো নদী শেষ চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে! পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। উন্নত বিশ্ব যখন চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে তখনো জানা নেই, দেশে আসলে নদীর সংখ্যা কতো?
নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিভ্রান্তি চলছে! ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত খসড়া তালিকায় নদীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫৬টি বলে উল্লেখ করা হয়। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায় দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ গ্রন্থে ৩১০টি নদীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিলো। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ছয় খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৫টি উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া নদী বিশেষজ্ঞ ও নদী বিষয়ক লেখকরা বিভিন্ন সময় নদ-নদীর সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
সরকারি বিভিন্ন বই ও প্রতিষ্ঠানে নদীর সংখ্যায় বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। এসব ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মূলত নদী রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাবকেই তুলে ধরে। কোনো কোনো নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে, অথচ বাস্তবে নেই। অনেকের লোভ-লালসার ছাপ পড়েছে নদীর ওপর। নদী দখল করে অনেকে মাছ চাষ করছেন, বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করছেন নদীর ওপর, নদীর জমি দখল করে অনেকে নেতা বনে গেছেন, অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যের লাইন জুড়ে দিয়েছে নদীর সঙ্গে। অনেক স্থানে গৃহস্থালির বর্জ্যের লাইন জুড়ে দেয়া হয়েছে নদীর সঙ্গে।
আবার কোনো কোনো স্থানে শহরের সিটি করপোরেশনের ময়লা-আবর্জনা গিয়ে পড়ছে পাশের নদীতে। শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। নদ-নদী দূষণ-দখল আর ভরাটের সঙ্গে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। বিভিন্ন সময় তারা নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নদ-নদীগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে! নদী দখল-দূষণকারীরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে না। নদীখেকোরা অবোধের মতো প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে মেতে উঠেছে।
নদীও কথা বলে, নদীরও সুখ-দুঃখ আছে। যুগের পর যুগ নদ-নদীগুলো আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে। নদীগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে চলেছে। মনে রাখতে হবে নদীগুলো আমাদের সম্পদ ও সৌন্দর্য। নদ-নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। নদীতে বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে একটার পর একটা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, উৎসমুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ছোট ছোট খাল-বিল, শাখানদী, উপনদীগুলো ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে বড় বড় নদ-নদীতে পানি সরবরাহের উৎসে এখন টান পড়েছে। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হয়েছে ও হচ্ছে। বছরের পর বছর নদ-নদী বাঁচাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সেসব অর্থের যথার্থ ব্যবহার হয়নি। সময়মতো নদীগুলো খনন করা হয়নি।
আর হলেও নদী খনন কাজে দক্ষতার অভাবে নদ-নদীগুলোর পলি অপসারণ করার পরপরই নদ-নদীগুলো আবার ভরাট হয়ে গেছে। পলি অপসারণ করেই ওই মাটি নদীর তীরেই রাখা হয়েছে, ফলে সেই মাটি নদীতেই আবার এসে পড়েছে। এভাবে বছরের পর বছর নদীতে পলি ও বালু পড়ে ডুবোচরের সংখ্যা বেড়েছে। নদী খনন কাজে জবাবদিহি ও পরিকল্পনার অভাবে নদ-নদীগুলোর আজ বেহাল দশা। আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে নৌপথের সুবিধা অনেক। নৌপথে পরিবহন খরচ কম, জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। কিন্তু নৌপথ ক্রমাগত কমতে কমতে এখন নেমে এসেছে চার হাজার কিলোমিটারে। যদিও পানির মৌসুমে নৌপথ দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। ব্রিটিশ শাসনামলে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ১৪ হাজার। পাকিস্তানি আমলে নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার।
বিভিন্ন সময় নদীর তীরের জমি বেদখল হয়ে হাতছাড়া হয়ে গেছে। কোনো কোনো সময় নদীর জমি অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ বা বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। নদীর ওপর এমন সব অত্যাচার চলতে থাকলে সেদিন বেশি দেরি নেই যেদিন বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশের বদলে ‘নদীমৃত্যুর দেশে’ পরিণত হবে! আগে বাংলাদেশে নদী রক্ষায় এতো এতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছিলো না, অথচ তখন নদ-নদীর দখল-দূষণ-ভরাট কম হতো। আর এখন নদী রক্ষায় বহু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও নদ-নদীগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি হাইকোর্ট এক রায়ে দেশের নদ-নদী রক্ষায় কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছে। বলা হয়েছে, একজন মানুষের যেমন আইনগত অধিকারের সুযোগ আছে, তেমনি নদ-নদীর সে ধরনের অধিকার আছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সারা দেশের নদী দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। শুধু তালিকা প্রকাশ করলেই হবে না। কালক্ষেপণ না করে এখনই সময় নদ-নদী দখলকারীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার। নদী দখল-দূষণকারীদের ছাড় দিলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
বিদ্যমান আইনে সব প্রকার হীন স্বার্থের বেড়াজাল ভেদ করে নিরপেক্ষভাবে নদী হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে একটা অপসংস্কৃতি হলো, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের সুবিধাবাদীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিলেমিশে নদী দখল-দূষণ ও অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু তোলার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকে। অথচ তারা জানে না, একটু একটু করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টেকসইভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কীভাবে নষ্ট হচ্ছে। হাইকোর্ট ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে নদ-নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। তাই সময় এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরো লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় স্বাধীন ক্ষমতা দেয়ার। এ ছাড়া নদী বিষয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল করলে তা নদ-নদী রক্ষার্থে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। নদী পুলিশও গঠন করা যেতে পারে। নদ-নদী তথা প্রকৃতির ওপর বছরের পর বছর অত্যাচার করে কোনো সভ্যতা টিকেনি। তাই আমাদের সম্পদ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নদ-নদীগুলোকে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, একেকটি নদী একেটি পর্যটন ক্ষেত্রও বটে। পর্যটনের এ সম্ভাবনার দ্বার যতো বেশি সুস্থ থাকবে নদ-নদী রক্ষাসহ পর্যটনের বিকাশ ততো ত্বরান্বিত হবে। নদ-নদী রক্ষার্থে দেশের যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ছাড়া দেশের সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে নদ-নদী গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ রক্ষক হিসেবে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। নদী রক্ষায় স্থানীয় জনগণের কাছে নদীর সবধরনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরতে হবে। নদীর দখল-দূষণ রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। দেশের নদ-নদীগুলো বাঁচানোর এখনই সময়। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
লেখক: শিক্ষক