
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ৮৭ জন ধনাঢ্য ব্যক্তি, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে ডেভিসন রকফেলার যে তৃপক্ষীয় কমিশন গঠন করেছিলেন তাই আজকে আলোচিত ‘ডিপ স্টেট’ বা ছায়া রাষ্ট্র বা সরকারের পেছনের সরকার। এই ‘ডিপ স্টেট’কে কিন্তু আপনি আবার পুরোপুরি সরকার মনে করে ভুল করবেন না। এর সদস্যরা শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রভাবশালীরা এই কমিশনের সঙ্গে জড়িত।
এরা মূলত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ এবং অর্থ বিভাগের একাংশের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের মাঝে গোপন ও স্বতঃস্ফূর্ত যোগাযোগ রক্ষা করে। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়কে হাতের পাঁচ আঙুলের মতো ব্যবহার করে থাকে। যদি কোনো রাজনীতিবিদ এর ওপর ভর করে গিয়ে পরে তাদের ভুলে যান, এ সংস্থাগুলো দ্রুত গতিতে তা আবার স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করে না। এর সদস্যরা খুব কম সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু সব সময় তাদের পছন্দের মানুষ দিয়ে সরকার গঠন করে তা পরিচালনা করাই ‘ডিপ স্টেট’ এর উদ্দেশ্য। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সব সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করা আর বাণিজ্য করাই এই অদৃশ্য সরকারের কাজ।
লোফগ্র্রেন বলেছেন, ডিপ স্টেট দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। তা হলো-অপরিহার্য জাতীয় নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক সংস্থার আধিপত্য। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই ডিপ স্টেট সম্পর্কে বলেছেন, প্রকাশ্য সরকারের পেছনের সিংহাসনে আসীন থাকে এক অদৃশ্য সরকার যার জনগণের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই ও আনুগত্যও নেই।
সাবেক মর্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শিক্ষক জিবনিউ ব্রেজিনস্কি ছিলেন এই তৃপক্ষীয় কমিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই কমিশনের সদস্য লুকাস পাপাডোমস এবং মারিও মন্টি যথাক্রমে গ্রিস ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বুশ, ক্লিনটন, ডিক চেনি, আল গোরও এই কমিশনের সদস্য হিসেবে বিশ্বঅর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন; এখনো করছেন বলেও ধারণা প্রচলিত আছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টরাও বেশির ভাগই এই কমিশনে যুক্ত থাকেন।
এই ছায়ারাষ্ট্রই নির্ধারণ করে দেয় শক্তিশারী ও সম্ভাবনাময় দেশগুলোতে কোথায় কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় যাবে। এই নির্ধারণ আবার নির্ধারিত হয় কতোটুকু সুবিধা বা সুযোগ এই ক্ষমতা প্রত্যাশী দল ক্ষমতায় গিয়ে তাদের দিতে পারবে তার মাফকাঠিতে। এক সময় এই মীমাংসা হতো সরাসরি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। শক্তিশালী রাজা বাদশারা ক্ষমতা সরাসরি দখল করে নিতো। পরে তা রক্ষা করতো অস্ত্রের সাহায্যে। প্রতিপক্ষ তাদের চেয়ে শক্তিশালী হলে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখলে নিতো। এখন এটা অবশ্য হয় নির্বাচন নামক বুদ্ধিচর্চার মাধ্যমে। কখনো সংস্কার, কখনো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্র পুনরোদ্ধার ইত্যাদি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বুলি মুখে থাকলেও স্বার্থই বড় কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় টেলিভিশন শো দ্য এক্স-ফাইলসে একটি ধারণা জনপ্রিয় হয় যে গুপ্ত সরকারের সদস্যরা কাউনসিল অব ফরেইন রিলেশনস, রয়াল ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ারস, দ্য ট্রাইলেটারেল কমিশন, দ্য বিল্ডারবার্গ গ্রুপ, সিআইএ এবং এমআই-৬ এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে বা এদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ব ব্যাংক এবং ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টেও আনুকূল্য পায়।
দ্য ডিপ স্টেট: ‘দ্য ফল অব দ্য কনস্টিটিউশন অ্যান্ড দ্য রাইজ অব শ্যাডো গভর্নমেন্ট’ এ মার্কিন কংগ্রেসের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাইকেল লোফগ্রেন বলেছেন, ডিপস্টেটের সদস্যরাই নির্বাচনে প্রার্থীদের সাহায্য করে। নির্বাচিতদের তথ্য দিয়ে তাদের নীতি ও কর্মপন্থা এমনভাবে নির্মাণ করিয়ে নেয় যেনো পাকা ফল তারাই তুলতে পারে। অর্থাৎ অন্যের নামে তারাই শাসন-শোষণ ও নির্বাচন করেন। এদেরকে কিন্তু পেছনের দরজা ব্যবহার করা লোক ভাবলে ভুল করবেন। কারণ, এরাই প্রতিষ্ঠান বা এসটাবলিশমেন্ট বলে পরিচিত। যার ওপর ভর করে থাকতে হয় সবাইকেই। জনপ্রতিনিধি বা জনগণের সেবকদের নাম ব্যবহার হলেও প্রতিষ্ঠানের নীতি, কর্মপন্থা বা কর্মকাণ্ড প্রস্তুত এবং বাস্তবায়ন ডিপস্টেটের সদস্যরাই করে থাকেন। এই এসট্যাবলিশমেন্ট সরকারি-বেসরকারি এবং অন্য সব সংস্থার সর্বস্তরেই আছে। কখনো দুঃসময় আসলে এসব কর্মকাণ্ডের দায়ভার জনপ্রতিনিধিদেরই নিতে হয়। কারণ, জনগনের কাছে তারাই দৃশ্যমান থাকেন, ডিপস্টেটের সদস্যরা নন।
জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে ডিপ স্টেট জনগণের সাধারণ অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের একটি ভীতির রাজ্যে নিমর্জিত করে রাখে। নিরাপত্তার নাম বলে তারা রাষ্ট্রকে নানা সংঘাতে জড়িয়ে ফেলে আর্থিক সুবিধা লুটে নেয়। ডিপ স্টেটের একটি প্রিয় কর্মকাণ্ড হচ্ছে যুদ্ধ। তারা নানা বিষয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সামাজিক অশান্তি উসকে দেয়। সংকট তৈরি করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লুফে নিতেও অপেক্ষায় থাকে। ঋণগ্রস্ত মার্কিন সরকার যখন প্রায় অচল হয়ে পড়ে বা ভীষন অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে তখনই নাইন ইলেভেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের পতন, আফগানিস্তানে আক্রমন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজায় গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটে বলেও ধারণা করা হয়।
অ্যাটর্নি ও লেখক জন ডাবলু হোয়াইটহেড তার ‘ব্যাটলফিল্ড আমেরিকা: দ্য ওয়্যার অন আমেরিকান পিপল’ বইতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ডিপ স্টেট আসলে পুলিশি রাষ্ট্র বলতে যা বোঝা যায়, সত্যিকারভাবে তাই সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সব দেশে এমন অবস্থা বিরাজ করছে এবং এটা অপরিবর্তনীয়। কারণ, এই অদৃশ্য শক্তিধর গোষ্টির কারণে ধনী আরো ধনী হয়, গরিব হয় আরো গরিব হয়। মিলিটারি আরো যুদ্ধবাজ হতে পারে। অশান্তি জিইয়ে রেখে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। আণবিক যুদ্ধ হলে তার ফলাফল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্সিকে রক্ষায় ব্লুন্টের কাছে মাউন্ট ওয়েদারে মাটির নিচে এক বিশাল শহর তৈরি রাখা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন হোয়াইটহেড। বিপদের সময় প্রেসিডেন্ট ছাড়া শুধুমাত্র ডিপ স্টেটের অধিবাসীরাই সেখানে থাকবেন। জনগণ নয়।
মেক্সিকোর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম অঙ্গরাজ্য ইউটাতে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৭০ কোটি ডলার খরচ করে ইউটাহতে ১৭টি ফুটবল মাঠের সমান একটি দালান কার স্বার্থে নির্মাণ করা হয়েছে? বলা হয় আপনার আমার মতো বিশ্বের প্রতিটি মানুষের তথ্য পাওয়া যাবে সেখানে। যারা আকার হবে ৫০০ কোটি লাখ পাতার সমান। এ ছাড়া ওয়াশিংটনে ৩৩টি প্রতিষ্ঠানে ৮ লাখ ৫৪ হাজার বেসরকারি গোয়েন্দা কাজ করে ডিপস্টেটের হয়ে এমন ধারণাও প্রচলিত আছে। যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই বিশ্বের প্রয়োজনীয় সব প্রতিষ্ঠান ও মানুষের তথ্য অনুসরণ করে এই বিশাল কর্মীবাহিনী।
দ্য টেরর ফ্যাক্টর বইয়ের তথ্যে দেখা যায় ডিপ স্টেটের প্রধান অঙ্গ হলো গোয়েন্দা। বিশেষ করে এফবিআই এবং সিআইএ’র বিশাল বাজেট ও লোকবল এবং এদের কর্মপরিধি বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের সব দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এদের এজেন্ট থাকে। ‘ম্যানুফ্যাকচারিং টেররিস্ট’ আলোচনায় ট্রেভর, যা দেখিয়েছেন তা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও এর সঙ্গেও আছে ডিপস্টেটের নাম। যেমন- হালে ডিপস্টেট নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শুরুতেই মার্কিন প্রশাসনের খড়্গ নামে ইউএসএআইডিতে। এমন সংস্থার মাধ্যমেই জনগণের চিন্তাকে ভিন্ন দিকে নিতে একটি গ্রুপ বা গোষ্টি তৈরি করা হয়। যেমনটা আমাদের দেশেও হয়েছে। দলে দলে তরুণ-তরুণীদের নিয়ে সেমিনার সিম্পজিয়া আর বিভিন্ন দিবস ভিত্তিক কর্মসূচি পালন হয়েছে রাজধানীসহ সারাদেশে, যাকে কেউ কখনো সন্দেহের চোখে দেখেনি।
বিশ্লেষকদের মতে রাষ্ট্রীয় আড়িপাতা, অস্ত্রশক্তি, অর্থ এবং স্বার্থবাদীদের সহায়তায় ‘ডিপ স্টেট’ এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, এর কোনো পতন সম্ভব নয়। জনগণকে এর ভার সইতেই হবে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এর কর্মকাণ্ডেও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। জনগণ কখনোই জানতে পারবে না তাদের অজান্তে তাদের সব অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তাদের শাসন-শোষণ করছে সারা পৃথিবীর গুটিকয়েক মানুষ। যারা দেশে আপনার আমার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা সরকারের মধ্যেই থাকে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক