ঢাকা বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫ , ১৮ চৈত্র ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

স্বাধীনতা মিললেও মুক্তি মেলেনি

মতামত

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২৬ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

স্বাধীনতা মিললেও মুক্তি মেলেনি

বাঙালির জাতীয় জীবনে মার্চ মাসের তাৎপর্য বিশেষ ও ব্যাপক। মার্চেই এসেছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতির ডাক। ২৫ মার্চ রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বাঙালিরা বদলা ও বদল দুটোই চেয়েছিলো। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মধ্য দিয়ে এসেছিলো সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চেতনা আমাদের কাছে অনন্ত প্রেরণা। যে প্রেরণা তরুণ প্রজন্মকে নিষ্ঠার পথে নিয়ে যায়।

যে প্রেরণা তরুণ সমাজকে সকল প্রকার অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা থেকে দূরে রাখে। যে প্রেরণায় ঋদ্ধ হয়ে তরুণ সমাজ মন্দকে মন্দ আর ভালোকে ভালো বলার দীক্ষা নেয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো ঘাটতি নেই। দেশপ্রেমের মশাল জ্বেলে তরুণরাই সোনার বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই তরুণরাই জুলাই অভ্যুত্থানে বৈষম্য হঠিয়ে মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে পথে নেমেছে। এই তরুণরাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে ফুঁসে উঠেছে।

‘স্বাধীনতা’ শুধু একটি শব্দ নয়, এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। স্বাধীনতা মানে সত্য ও সুন্দরের পথে চলা। স্বাধীনতার অর্থ চিন্তা ও মতপ্রকাশে স্বাধীন, অনিয়মের বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগ্রত করার অধিকার। সর্বদা ভালো কাজ করা ও ভালো কাজ করতে দেয়ার অধিকারই স্বাধীনতা। সময়, স্থান ও ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীনতা শব্দটি বিশেষ বিশেষ অর্থ বহন করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার অর্থ আর স্বাধীন দেশে তথা বর্তমান সময়ে স্বাধীনতার অর্থের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একজন নারীর পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচার অধিকার বা স্বাধীনতা রয়েছে। কন্যাশিশুসহ সব শিশু কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হবে না-শিশুদের এই চাওয়াটা নিশ্চয় দোষের নয়। একজন কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ঠ বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া একজন নারীর কাছে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা অনেক বেশি অর্থবহ। ভোটের দিন একজন নাগরিকের কাছে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে ভোট দেয়ার অধিকার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

একজন পথশিশুর পড়ালেখার অধিকার বা স্বাধীনতা তার কাছে সবচেয়ে দামি। শেয়ারবাজারে কারবার করা একজন বিনিয়োগকারী হঠাৎ করে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে না-এ নিশ্চয়তা পাওয়ার অধিকার সে রাখে। একজন দুধ বিক্রেতা দুধের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার রাখে। একজন নারী তার পোশাকের কারণে রাস্তাঘাটে কটু কথা বা নেতিবাচক আচরণের শিকার হবে না-এটা একজন নারীর অধিকার। পড়ালেখা শেষ করা একজন তরুণ চাকরি করতে এসে ঘুষ-দুর্নীতি-হয়রানির শিকার হবে না-এটা একজন তরুণের অধিকার। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে থাকা একজন বেকার যুবকের অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য তথা উদ্যোক্তা বা ভিন্ন কিছু হওয়ার জন্য রাষ্ট্র থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

হাসপাতালে সেবা নিতে এসে চিকিৎসা শেষে বিলের নামে গরিব রোগীর ‘গলাকাটা’ হবে না-স্বাধীন দেশে এমন স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার গরিব জনগণের রয়েছে। একজন বয়স্ক ব্যক্তির ভাতা পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরার নাম স্বাধীনতা নয়।  
জীবনে স্বাধীনতা যেমন দরকার আছে তেমনি স্বাধীনতার মান রক্ষা করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, স্বাধীনতা হলো নিজের বিবেক আর সুইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতা মানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। স্বাধীনতা মানে অন্যের উপকারে আসা, অপরের প্রতি মার্জিত ও রুচিশীল ব্যবহার। স্বাধীনতা মানে ক্ষমতাবলে অন্যের অধিকার কেড়ে নেয়া নয়। স্বাধীনতা মানে অসচ্ছল, প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা বলা। যুক্তির আলোয় মুক্তির সন্ধান করা মানুষদের নিজের মতামত প্রকাশ বা চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা মানে স্বাধীন চেতনায় বাস করা। অন্যের মতামত বা ভিন্নমত দমন করা নয়, স্বাধীনতা মানে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। স্বাধীনতা মানে ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটা নয়, স্বাধীনতা মানে ভিন্ন মতের ওপর চাপ প্রয়োগ নয়। স্বাধীনতা মানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার বাস্তবায়ন করা। স্বাধীনতার অর্থ অনিয়ম, দুর্নীতি, অপকর্ম, ভিন্নমত দমন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুম ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা। সরকারি সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে একজন সাধারণ নাগরিককে হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হবে না-এ নিশ্চয়তা দেয়ার নামই স্বাধীনতা। আর বৈষম্য ও অব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে বুঝতে হবে হবে স্বাধীনতার অর্থ জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। স্বাধীনতা হলো রাষ্ট্র প্রদত্ত অধিকার সঠিকভাবে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। 

স্বাধীনতা মানে পরাধীনতার শিকলে বন্দী থাকা নয়, স্বাধীনতা মানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। একজন বেকার তরুণ যদি চাকরি না পেয়ে, পরিবারের আশা পূরণ করতে না পেরে কিংবা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় তাহলে বুঝতে হবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ সবার জন্য সমান হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতা মানে বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতা মানে দলীয়করণ নয়, পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে জনগণকে বোকা বানানো নয়। স্বাধীনতা মানে নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা। স্বাধীনতা মানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো। স্বাধীনতা মানে শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবের সম্মিলন ঘটানো। স্বাধীনতা মানে নিরপেক্ষভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করা। স্বাধীনতা মানে সুশাসন। স্বাধীনতা মানে দেশের ঊর্ধ্বে রাজনীতি নয়, রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেশ।

স্বাধীনতা যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে অর্থগত কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। স্বাধীন হওয়ার জন্য যুদ্ধ শেষ হলেও মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৫৪ বছর হতে চলেছে। দেশের জনগণই দেশটাকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি তবে দেশটা আরো এগিয়ে যেতে পারতো! ঘুষ-দুর্নীতির প্রসার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেশটাকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে! সার্বিকভাবে তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। অন্যথায় এতো স্বল্প সময়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হতো না। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে যেনো দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নেই। নদী ও বন দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ হলেও নদী ও বনখেকোরা এখনো বীরদর্পে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। ভিন্নমত প্রকাশের দরুণ জনৈক ব্যক্তির ওপর কখনো কখনো নেমে আসছে অজানা দুঃসংবাদ। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। এ যেনো শুভংকরের ফাঁকি! স্বাধীনতার স্বাদ পেলেও সর্বক্ষেত্রে মুক্তি মেলেনি।

উন্নয়নের পাশাপাশি বেড়ে চলেছে বৈষম্য। ধনীরা আরো ধনী আর গরিবরা আরো বেশি গরিব হচ্ছে। হাড়ভাঙা খাটুনি করে পোশাক শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরাই এই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ‘নির্যাতিত বেতন কাঠামো’ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালুর দাবিতে সব পর্যায়ের শিক্ষক সমাজ বহুদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। এ দেশটা সবার। দেশে সর্বক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা যতো বজায় থাকবে দেশটা ততো এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই অভ্যুত্থানের মূল চেতনা তথা সবক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হলেই তবেই কেবল প্রকৃতপক্ষে মুক্তি মিলবে। উন্নত সোনার বাংলা গড়তে হলে স্বাধীনতার চেতনায় তরুণ সমাজের পাশাপাশি সবাইকে ঋদ্ধ হতে হবে। হে স্বাধীনতা তোমার চেতনায় ঋদ্ধ করো।

লেখক: শিক্ষক

জনপ্রিয়