
শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ব্যতিরেকে স্বনির্ভর জাতি গঠন সম্ভব নয়। সাধারণত বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের সন্তানরা প্রায় সবাই শিক্ষিত। একমাত্র নিম্নবিত্ত শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া জনগণের সন্তানরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সকলের মাঝে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা না হলে জাতি তথা রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাদের শিক্ষার সুযোগ বিকশিত করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও, সবার কাছে শিক্ষার সুযোগ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। শিক্ষা বাণিজ্যকরণ হয়ে গরিব মানুষগুলোকে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
দেশের সরকার তথা কর্তা ব্যক্তিবর্গ জনগণকে বোঝাতে চাচ্ছে, শিক্ষার উন্নয়ন করে তারা দেশকে স্বর্গ বানাচ্ছে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গ্রামাঞ্চলের গরিব কৃষকসহ প্রজাদের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য ‘রুরাল এডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৩০ কার্যকর করেছিলেন। এতে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ উপকৃত হয়েছিলেন। তখন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন স্যার আজিজুল হক। তিনি সরকারি বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার মাধ্যমে ইংরেজি থেকে বাংলা তথা মাতৃভাষায় পরিবর্তন করার কাজটি করেছিলেন।
এতে শিক্ষার আলো প্রজ্জ্বলিত হতে শুরু করলো। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ হলেও, সরকারগুলো অনাদর তথা অবহেলা প্রাথমিক শিক্ষা তার কাঙ্ক্ষিত সুনাম নিয়ে জাতির মন জয় করতে পারেনি। সংকটের মধ্যেই চলছে প্রাথমিক শিক্ষা। ‘ঘর আছে তো দরজা নেই, শিক্ষক আছে অবকাঠামো সুবিধা নেই’ সব আছে তো কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে পাঠদান বহির্ভূত নানা কাজে ব্যস্ত রাখে। তাতে শিক্ষকেরা পাঠদানে সময় দিতে পারেন না।
সীমাহীন অব্যবস্থাপনার মাঝে পর্যুদস্ত আজও প্রাথমিক শিক্ষা। এ নাজুক অবস্থা চলতে চলতে, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা স্যার আজিজুল হক ইংরেজি মাধ্যমকে বাংলা করার ব্যবস্থা ও জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি সরকার কর্তৃপক্ষের সমস্যা দূরীকরণে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিক শিক্ষার সুনাম তলানিতে পৌঁছেছে। গাছের গোড়ায় পানি না দেয়ার ব্যবস্থা না করে, মানে সমস্যা সমাধান না করে, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, নীতিনির্ধারকরা স্বীয় ত্রুটি অবলোকন না করে, মাঠে-প্রান্তরে, সভা-সমাবেশ সর্বত্র নতুন সুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া হয় না বা প্রাথমিক শিক্ষকেরা লেখাপড়া করান না। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মতো। স্বাধীনতা পর থেকে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ও পৃষ্ঠপোষকতা তৈরি হয়েছে শিশুশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। পাড়ায়-পাড়ায়, আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন তথা হাইস্কুলের প্রাথমিক শাখা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাথমিক শাখা খোলা হয়েছে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে। এতে একদিকে শিশুশিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ, অপরদিকে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাদানের ফলে শিশুর মেধা বিকাশে বিঘ্নিত হচ্ছে।
আমাদের দেশের জনগণের শতকরা ৯৯ জন অভিভাবক জ্ঞান অর্জন তথা পরীক্ষায় ভালো পাসের তফাৎ বোঝেন না। তারা মনে করেন, ভালো ফলই জ্ঞান অর্জনের মাপকাঠি। বাস্তবে জ্ঞান অর্জনই হলো শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সঙ্গে জ্ঞানের পরিপূর্ণতা প্রয়োজন। বেসরকারি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সরকারি, বেসরকারি, উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত। বিধায় তারা শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন তথা মেধাবিকাশে পরিবর্তে পরীক্ষায় ভালোফলের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন। আমাদের সমাজের অভিভাবকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সেখানে মেধা বিকাশমুখী, শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়।
অথচ সরকার ও নীতিনির্ধারকগণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন। বছরের শেষ মাস থেকে ভর্তিসহ নানা কর্ম চলে তাদের তৎপরতা। যেখানে শিশুশিক্ষার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ সেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই।
আজ সময় এসেছে, শিশুশিক্ষার সব কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি। এ ছাড়া শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বিঘ্ন ঘটে, এমন সকল পাঠ বই থেকে মুক্ত করা। শিক্ষার প্রথম স্তর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি। দ্বিতীয় স্তরে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি। বর্তমানে বহু সংখ্যক উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলছে। শিশু শিক্ষার্থীর মেধার পরিপূর্ণতা বিকাশের স্বার্থে সরকারি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বিলোপ করা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে তাদের নির্ধারিত শ্রেণির বাইরে পাঠদান যথার্থ নয়। এতে শিক্ষায় বাণিজ্যকরণ প্রসারিত হচ্ছে। অপরদিকে অসচ্ছল মানুষের সন্তানদের অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শিক্ষার প্রথম স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা ৭২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করা থেকে সরে এসে, বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষকতা করা। এতে এদেশের অসচ্ছল মানুষের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে। নচেৎ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হবে। এই ক্ষোভ হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবক শিক্ষক সমাজসহ জাতির।
শিক্ষা জনগণের মৌলিক চাহিদা। অবৈতনিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। এনজিও দ্বারা পরিবেষ্টিত কলসালটেশন কমিটির ৭২৯টি অষ্টম শ্রেণির বিদ্যালয় বন্ধ করার পরামর্শ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ।
এতে অসচ্ছল মানুষের শিক্ষার অধিকারের সম্প্রসারণ ও প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের চ্যালেঞ্জের নির্দেশনা ভুক্তভোগীরা সহজে মেনে নেয়ার কথা নয়। এর বিরূপ পরিবেশের দায় বহন করতে হবে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ৭২৯টি বিদ্যালয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির কার্যক্রম বন্ধের ষড়যন্ত্র থেকে বের হয়ে আসবেন। বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে পদক্ষেপ নেবেন। পাশাপাশি অসচ্ছল মানুষের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষার অধিকার সম্প্রসারণ করার ব্যবস্থা নেবেন-এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষাবিদ