ঢাকা বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫ , ১৮ চৈত্র ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রবীণরা সম্মানিত হোক জীবনজুড়ে

মতামত

মো. আবু সাঈদ, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০০:১০, ৩০ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

প্রবীণরা সম্মানিত হোক জীবনজুড়ে

পিতা-মাতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির জন্য তাদের মারধর বা ভাত-কাপড় না দেয়ার খবর পত্রিকার পাতায় আসে প্রায়শই। হৃদয়বিদারক ও নির্মম এমন বহু ঘটনা যেমন চোখ ভিজিয়ে দেয় তেমনি মেহেরপুর সদরের কুতুবপুর ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া গ্রামের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ঘটনাটির মতো বিষয়গুলো আশা জাগায়। স্বপ্ন দেখায়। পত্রিকার পাতায় পড়ে মনে হলো যেনো মেহেরপুরের কুলবাড়িয়া গ্রামের ঈদগাহ মাঠে বছরের একটি বোনাস ঈদ হয়েছে। নবীনদের আয়োজনে প্রবীণদের জন্য এমন ভালোবাসা সত্যি বিরল।

প্রবীণদের পাশাপাশি সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ আর অফুরান ভালোবাসা জানাই কুলবাড়িয়া গ্রামের সেইসব তরুণদের। যারা দৃষ্টান্ত হতে পারেন দেশের কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর কাছে। নিজের মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মানবোধ থেকেই অন্য বাবা মাকে একটু শ্রদ্ধা জানানোর ধারণাটা অসাধারণ।

বিখ্যাত মনীষী, উইলিয়াম পেন বলেছেন, ‘পৃথিবীতে ঈশ্বরের পরবর্তী স্থানই হলো মা-বাবার। প্রতিটি সন্তানকে মা জন্ম দেয়ার পাশাপাশি লালন-পালন করেন। আর এই সন্তানকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন বা পালন করেন বাবা। পারিবারিক শিক্ষা নিশ্চিত হয় বয়োজ্যোষ্ঠদের থেকেই। তাই বলা হয়, পিতা-মাতার ঋণ কোনোভাবেই কোনো সন্তান কখনো শোধ করতে পারে না। জনপ্রিয় গানের লাইন নিশ্চয় সবার মনে থাকার কথা ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম পাপোস বানাইয়া দিলে শোধ হবে না’। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’

কোরআনুল কারিমের সুরাআন-নিসা ৩৬ আয়াতে আল্লাহ মানুষকে তার এবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার সঙ্গে কাউকে শরিক করতেও নিষেধ করেছেন। পাশাপাশি মা-বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে উত্তম আচরণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বাবা-মার সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার করা ইসলামের অনুসারীদের ইমানি দায়িত্ব ও কোরআনের নির্দেশ।

সনাতন ধর্মে বাবা-মায়ের স্থান অত্যন্ত উচ্চ। উপনিষদে বলা হয়েছে: ‘মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব।’ অর্থাৎ, মাকে দেবীর মতো আর বাবাকে দেবতার মতো পূজা করতে হবে। কারণ, আমাদের জন্ম ও জীবন, উভয়ই তাদের অবদান। মহাভারতে ভিস্মকে তার গুরুরা কী শিক্ষা দিয়েছেন পিতা সান্তনু জানতে চাইলে গঙ্গাপুত্র জানিয়েছিলেন, তার গুরু শিখিয়েছেন-শিক্ষকের চাইতে আচার্য্যের অধিকার দশগুণ বেশি। পিতার অধিকার আচার্য্যের অধিকারের শতগুণ বেশি। মাতার অধিবার পিতার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি। কারণ, পুত্র কুপুত্র হলেও হতে পারে কিন্তু মাতা কখনো কুমাতা হন না। মা হলো পৃথিবী আর সন্তান হলো অঙ্কুর। পৃথিবীর মাটিকে বীজ দিলেই শুধু মাত্র চারা গজাবে। কিন্তু বীজ যতোক্ষণ পর্যন্ত মাটির স্পর্শ না পায় ততোক্ষণ পর্যন্ত তার সঠিক অঙ্কুর গজায় না।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু তুলনামূলক বেশি। আমাদের দেশে সরকারি হিসেবে ৬৫ বছরের বেশি মানুষ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে গণ্য। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের এক জরিপে দেখা গেছে দেশের ১ কোটি ৬০ লাখ প্রবীণ ব্যক্তি, যা ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় দুই কোটি হওয়ার কথা। এখন আমাদের সমাজে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন মানুষ প্রবীণ। এতো প্রবীণ বাড়ার কারণ অবশ্য ভিন্ন। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের সবশেষ তথ্যমতে দেশর মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। যেখানে ভারতের ৬৭ বছর, নেপাল ৬৭ বছর ও পাকিস্তানের মাত্র ৬৬ বছর বছর। অন্যদিকে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গড় আয়ু নিয়ে মানুষ বাঁচে মোনাকোয়। তাদের গড় আয়ু প্রায় ৯৪ বছর। জাপানে ৮৪, সিঙ্গাপুরে ৮২, হংকংয়ে ৮২, অস্ট্রেলিয়ায় ৮৪ ও চায়নায় গড় আয়ু ৭৪ বছর।

দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে শতাধিক প্রবীণ নিবাস আছে। কিছু মহৎ মানুষের উদ্যোগে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে। কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও হয়েছে মেডিক্যাল সেবাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। কিন্তু কথা হলো মেহেরপুরের তরুণরা যা করেছেন তা কি নতুন মডেল হতে পারে না সারাদেশে? বছরের কোনো নিদিষ্ট দিনে এক একটি এলাকার তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে হয়ে তাদের স্থানীয় প্রবীণদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাতে পারেন না? এখন কর্মক্ষেত্রে এসে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে শৈশবে ফেলে আসা স্কুল শিক্ষক, বাড়ি পাশের চায়ের দোকানি, স্কুলের সামনের চানাচুর বিক্রেতা, বাড়ির কাজের লোকটা বা প্রতিবেশী কাকা, কাকি, দাদা, দাদি যাদের বাগানের আম, লিচু বা কুল গাছে ঢিল দিয়েছেন এক সময় তাদের জন্য বছরের একটি দিন হতে পারে না? আমাদের তারেুণ্যের উত্তাল সাগরের তাদের জেঁকে ধরা বয়সের ভিড়কে একদিন হারিয়ে দিলে মন্দ হয় না তো? তাদের কাছ থেকে আগেভাগেই আমরা হয়তো এই জীবনের অভিজ্ঞতাটাও অর্জন করতে পারি, যা তারা পেছনে ফেলে এসেছেন।

পাশাপাশি সমাজ ও দেশের কল্যাণেই আমাদের প্রবীণদের দিকে এখনই আরো সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। শুধু বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাস নামের যন্ত্রণার সাগরে না ভাসিয়ে পরিবারের প্রবীণদের রাখতে হবে নিজের পরিবারের সঙ্গেই। মনে করেন আপনারা স্ত্রী বা স্বামী দুজনই চাকরিজীবী। নিয়ম করে অফিসে যান আর বাসায় ফিরেন। আপনার সন্তান কিন্তু বেড়ে উঠছে কাজের লোকের কাছে। কিন্ত এই জায়গায় যদি আপনার বাবা-মা বাসায় থাকেন, দাদা-দাদি হিসেবে শিশুটি আপনজনকে পাশে পাবে। আপনার বাবা-মা আপনাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন সেই পারিবারিক শিক্ষাগুলো আপনার সন্তানও পাবে।

শহর বা কর্মক্ষেত্র থেকে আপনার গ্রাম যদি হয় নিরাপদ দূরত্বে তাহলে সন্তানকে একটি নিদিষ্ট সময়ের পর গ্রামীণ পরিবেশেও রাখতে পারেন কিছুদিন। যাতে যে দাদা দাদি বা নানা-নানির কাছ থেকে পরিবারিক শিক্ষাও পেলো, ইট কাঠের জঞ্জালের নগরি ছেড়ে গ্রামকেও চিনলো জানলো। সময় সুযোগ হলে সপ্তাহান্তে কর্মজীবী মানুষ হিসেবে আপনারাও ছুটে গেলেন আপনাদের সন্তাকে দেখতে। তাতে বোনাস হিসেবে আপনার বাবা-মাও তাদের সন্তানকে পাশে পাবে। তা ছাড়া তাদের জীবনবোধ আর অভিজ্ঞতাকেও আমাদের কাজে লাগাতে হবে। দেশের উদিয়মান অর্থনীতিতে তাদের শারীরিক শ্রমের চেয়ে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি কাজে দিবে। পাশাপাশি এই বিশাল সংখ্যক প্রবীণদের শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ, যা রক্ষা করে সমাজ ও দেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

জনপ্রিয়