ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫ , ১ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বৈষম্যের বলয়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন

মতামত

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১০ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

বৈষম্যের বলয়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন

নারী নির্যাতন মানবাধিকারের সবচেয়ে লজ্জাজনক লঙ্ঘন। এই নির্যাতনের কোনো ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক বা চিত্ত বৈভবের সীমারেখা নেই। যতোদিন এটি থাকবে ততোদিন সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি ব্যাহত হবে।

সারা বিশ্বে নারী নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী ও মেয়ে পাচার, বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তি এবং সশস্ত্র সংহাতে নির্যাতন, যেমন-হত্যা, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, বাধ্যতামূলক গর্ভধারণ। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে ঘরে-বাইরে দিন কিংবা রাত- কোথাও নিরাপদ নয় নারী ও কন্যাশিশু। আরো বেশি অসহায় প্রতিবন্ধী নারী-শিশুরা। প্রতিনিয়ত তারা যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আইনের শাসন ও বিবেক জাগ্রত না হওয়ার কারণে আমাদের দেশে সহিসংতার মাত্রা ও রূপ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধরনের নির্যাতনগুলো ভয়াবহ মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ হলো অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা নেয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে বেশিরভাগ নির্যাতিতই পাচ্ছেন না বিচার।

আইনের অপপ্রয়োগে ধ্বংস হচ্ছে অনেক পরিবার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের স্বার্থেই আইনকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সরকারি জরিপে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী কোনো না কোনো সময় নির্যাতনের শিকার হন। ঘরে বা বাইরে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার এই নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা পর্যন্ত নিতে চান না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি সম্প্রতি বলেছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিভিন্নমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বছরব্যাপী এবং গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত পক্ষকালব্যাপী নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করছে।

নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা যে ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা দেখে মনে হয় সমাজ একটি বিবকেহীন, পাশবিক বৈকালঙ্গের দিকে এগোচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সকলকে সমাজের বিবেক জাগ্রত করতে হবে, পরিবারের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। কারণ, গত তিন দশকে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে অনেক আইন হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ডেমিনিকা প্রজাতন্ত্রের তিনজন নারী নেতা তৎকালীন সে দেশের শাসক রাফায়েল ক্রুজিলোর নির্দেশে আততায়ীর হাতে খুন হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর গৃহীত এক সিদ্ধান্তে ২৫ নভেম্বরকে আর্ন্তজাতিক নরী নির্যাতন বিলোপ দিবস ঘোষণা করে (সিদ্ধান্ত ৫৪/১৩৪)। এর আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে নারীর মর্যাদা সংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিশনের ৪২তম অধিবেশনে সকল প্রাসঙ্গিক নীতি ও কর্মসূচিতে লিঙ্গ প্রেক্ষিতকে মূল ধারাভুক্ত করাসহ নারী নির্যতনের অবসানে সদস্য দেশসমূহ ও আর্ন্তজাতিক সমাজের কর্ম পরিধি আরো প্রসারিত করার প্রস্তাব দেয়া হয়।

উক্ত অধিবেশনের সম্মত উপসংহারের মধ্যে বেসরকারি সংস্থার কাজে সর্মথন দান, নারী ও মেয়েদের সবধরনের পাচার রোধ, অভিযানকারী শ্রমিক (বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার এগিয়ে নেয়া এবং রক্ষা করা) নারী নির্যাতন সম্পর্কে সমন্বিত গবেষণাকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থাবলি অন্তর্ভুক্ত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ১০ মাসে মোট ৪ হাজার ১৪৪ জন নারী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৭৫ জন।

এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৪০ জনকে। উত্ত্যক্ত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৩৩১ জন। এর মধ্যে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৪০ জনকে। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নির্যাতন করা হয়েছে ১২ জনকে এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭১ জন নারী।

বিশ্ব ব্যাংকের ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টের আলোকে জানা যায়, স্তনের ক্যানসার, সার্ভিক্যাল ক্যানসার, প্রসবকালীন সন্তান আটকে যাওয়া, ১৫ থেকে ৪৪ বয়সী নারীর জীবনের সুস্থ্য বছরগুলো ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতনের ছোবলে ঝড়ে যাওয়াসহ নানান প্রতিবন্ধকতার মাঝে সমাজে নারীদের প্রতি মুহূর্তে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

বাণিজ্যিক যৌন শোষণের জন্য নারী ও শিশু পাচার থেকে বছরে সর্বোচ্চ ৮০০ কোটি ডলার আয় হয় বলে আর্ন্তজাতিক অভিপ্রায় সংস্থা (আই ও এম) এর রিপোর্টের জানানো হয়েছে। অপরদিকে, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এর হিসাব অনুযায়ী সাড়ে ৮ কোটি থেকে ১১ কোটি ৪০ লাখ নারী ও মেয়ের স্ত্রী যৌনাঙ্গ ছেদন করা হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মহাদেশের নাগরিক।

বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ছিলো ১৭ হাজার ৭৫২টি। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫৫৯টি মামলা হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের মধ্যে ১০ ভাগের বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নারী-শিশু ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের ১০০টি অপরাধে গড়ে ২টির বেশি অপরাধের শাস্তি হয় না। গত ৫ বছরে সংগঠিত গণধর্ষণের ৯৮ শতাংশ অপরাধে কারও শাস্তি হয়নি। বিচার না হওয়ায় ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারী নির্যাতনের সঙ্গে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ঘরের মানুষ ও আত্মীয়স্বজনদের কাছেও নারী-শিশুর নিরাপত্তা নেই। এখানেও ধর্ষণের শিকার তারা। বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেছিলেন, ‘এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।’

নারী-পুরুষের বৈষম্যের একটি বর্বরতম প্রকাশ হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংস, নিষ্ঠুর আচরণ। নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা তথা বিবেক জাগ্রত করা জরুরি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং নারী আন্দোলন পারস্পরিক সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করলে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

 

জনপ্রিয়