
এদেশের সাধারণ মানুষ যেনো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ধমক আর ভীতি প্রদর্শন এড়াতেই পারছে না। প্রতিদিনই তাদের এসব অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলছে, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’। এটি আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু যখন বাস্তবে ঘটে তখন আর কিছু করার থাকে না। এ ধরনের উদাহরণ আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সবক্ষেত্রে দেখতে পাই। কিন্তু কেউই শিক্ষা নিই না। ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত বাতিলসহ ছয় দাবিতে এবার বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণ বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা।
আমাদের দেশের শিক্ষা বিভাগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব সমস্যা বিরাজ করছে তার সবগুলোই স্বল্পমেয়াদি কিংবা মধ্যমেয়াদি নয়। অনেকগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য। অথচ পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি তুলেছেন সেগুলোর সমাধান তারা যেভাবে চেয়েছেন তাতে মনে হয় সবই স্বল্পমেয়াদি অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সরকার ইচ্ছে করলেই দ্রুত সমাধান দিয়ে দিতে পারেন। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে, কোনো ধরনের সমস্যা স্বল্পমেয়াদি, কোনোটা মধ্যমেয়াদি এবং কোনটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। তাদের দাবি মানা না হলে তারা ফরম পূরণ বন্ধ রাখবেন। তাতে তারা নিজেরা এবং তাদের পরিবার ছাড়া কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বিষয়টি অবশ্যই তাদের ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত তারা যদি এটিই না বোঝেন যে, সব সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যায় না তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় তাদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতা কতোটুকু আছে। তৃতীয়ত বর্তমান সরকার এসব দাবি-দাওয়া শোনা এবং পূরণ করার জন্য কতোটা সক্ষম। সবাই থ্রেট দিয়ে কথা বলছেন। কাদের থ্রেট দেয়া হচ্ছে, কেনো দেয়া হচ্ছে? থ্রেট দেয়া ছাড়া কি আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধানের পথ আশা করতে পারি না?
হাইকোর্টের একটি রিটের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টররা পদোন্নতি পাবেন যেটিকে শিক্ষার্থীরা ‘কালো রিট’ আখ্যা দিচ্ছেন। হাইকোর্ট বিচার বিভাগের উর্ধ্বতন আলয়। সেখানকার সিদ্ধান্ত বা আইন কি সাধারণ শিক্ষার্থী কিংবা পলিটেকনিকে পড়া শিক্ষার্থীদের এতো সহজে বুঝতে পারার কথা? সমস্যা যখন জটিল হয় তখন মানুষ আদালতের আশ্রয় নেন। আদালতকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। তারপর সিদ্ধান্তে সন্তষ্ট না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যায়। নিজেদের বিরোধিতার কথা সম্মানজনকভাবে বলা যায়। সেই অবস্থা আমরা এখানে দেখছি না।
২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর সারা দেশের পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা একযোগে মাটে নেমেছিলেন ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। তারা সেদিন সাতরাস্তা বন্ধ করে দেন। দীর্ঘসময় সড়ক অবরোধের ফলে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিলো। ফলে, তৎকালীন সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন ও মহাপরিচালনক মো. আজিজ খান শিক্ষার্থীদের মাঝে এসে দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে তারা ব্লকেড তুলে নেন। সেই উদাহরণ শিক্ষার্থীরা আবার দিচ্ছেন যে, তারা এ ধরনের কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা যদি অনবরত ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন তাহলে তার কিন্তু উল্টো একটি ইফেক্ট রয়েছে।
এসব দাবি পালনের জন্য শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা কতোটা পজিটিভ অবদান রেখেছেন সেই প্রশ্ন নিজেদের করতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে, দাবির সঙ্গে তাদের নিজস্ব এবং দেশের সামর্থ্য ও চাহিদা অনুযায়ী সমাধানও বের করে দিতে হবে। শুধু ভয়ের সংস্কৃতি, চাপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে জনমনে ইতোমধ্যে যে ধারণা জন্মেছে এবং তারা বাস্তবে দেখছে তা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো, প্রতিষ্ঠা করা আর শিক্ষার্থীদের সেসব প্রতিষ্ঠানে পাঠানো মানেই হচ্ছে তাদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। কোটির ওপরের বেশি জনসংখ্যার এই ঢাকায় এমনিতেই মানুষের আধ ঘণ্টার জায়গায় তিন ঘণ্টায় কোথাও যেতে হয় যানজটের কারণে। সেখানে সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পান থেকে চুন খসলেই রাস্তায় নেমে পড়েন দাবি নিয়ে। কাজটি বেশ সহজ। গাড়ি তো এমনিতেই রাস্তা বন্ধ করে রাখে সেখানে শিক্ষার্থীরা নামলেই সহজেই রাস্তাঘাট ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ হয়ে থাকে। তারা ভেবেছেন এভাবেই দাবি আদায় করতে হয়। আজ পর্যন্ত বিকল্প কোনো পথ, বিকল্প কোনো আন্দোলন, জনদুর্ভোগ কমানোর কোনো দাবি বা পন্থা দেখতে পাচ্ছি না। সবাই শুধু থ্রেট দিয়ে যায়, কাদের থ্রেট দেয়া হচ্ছে, কিসের জন্য? যেসব দাবির কথা উঠলো সেগুলো সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পথ বাতলে দেয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমাধানের পথে এগোনো যেতে পারে। জনগণকে জানানোর জন্য হলে সংবাদ সম্মেলন করে শান্তিপূর্ণভাবে গণমাধ্যমে স্থান করে নিতে পারে। অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, সরকার তথা জনগণকে ভীতি প্রদর্শন করে এবং জনদুর্ভোগ চরমে উঠিয়ে এসব ইনডিভিজুয়াল দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ আমাদের সবধরনের শিক্ষার্থীদের পরিহার করতে হবে। দেশ ও জনগণ বহু সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহর পুরো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহর, এখানে শব্দদূষণ চরমে। এসব নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো আন্দোলন দেখতে পাই না। শুধু কিছু সমস্যা বের করে অযথা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ দেশ সকলের। কাউকে শত্রু বা প্রতিপক্ষ না ভেবে সবকিছুতেই শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করার পথ শিক্ষার্থীদের আবিষ্কার করতে হবে।
লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক