ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫ , ১ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কোথায়

মতামত

এস ডি সুব্রত, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১১ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কোথায়

সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই যে খবরটি সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয় সেটা হলো গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড। অথচ বিশ্ব নেতাদের এ ব্যাপারে বিচলিত হতে দেখা যাচ্ছে না। ফিলিস্তিনের গাজা একটি অতি ক্ষুদ্র অঞ্চল। একদিকে ভূমধ্যসাগর, আরেক দিকে মিসর, বাকি দুই দিকে ইসরায়েল।

মোট আয়তন মাত্র ১৪০ বর্গমাইল। একটা বড় অংশ মরুভূমি, ফলে বসবাসের অযোগ্য। এরই মধ্যে ঠাসাঠাসি করে প্রায় ২০ লাখ লোকের বাস, যাদের অধিকাংশই উদ্বাস্তু। অর্ধেকের বেশি মানুষ বেকার, জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। সেই গাজা জ্বলছে যুগ যুগ ধরে। গাজা হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। ফিলিস্তিন যেনো লাশের দেশ। [inside-ad]

ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে গাজার উত্তরাঞ্চল ভেঙে চুরমার, নিহতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে ইতোমধ্যেই। আহতদের সংখ্যা হাজার হাজার। হতাহতদের অধিকাংশই শিশু ও নারী। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান প্রথম এসেছিলো ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে জাতিসংঘের মাধ্যমে।

সে সময় বলা হয়, ইসরায়েল হবে ইহুদিদের জন্য এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য। তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। যেটা আরবরা মানেনি। আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেটা চলছে এখনো।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। থেমে থেমে ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়মিত চলছে। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল পৃথক দুটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রথমবারের মতো বাস্তবতার দিকে এগোতে শুরু করে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে নরওয়ের অসলোতে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে, যেটা ‘অসলো অ্যাকর্ড’ নামে পরিচিতি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর এবং গাজায় সরকার পরিচালনার জন্য একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়।

এটা গঠনের সময়সীমা ছিলো পাঁচ বছর। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা স্বীকার করে নেয় ইসরায়েল রাষ্ট্রকে। চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য খুব দ্রুতই পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরই শান্তি প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। নানারকম বাধা তৈরি হয়। অসলোতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়া হলেও সেই রাষ্ট্র কবে গঠন হবে তার কোনো সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি।

এমনকি ইসরায়েলের বাইরে আলাদা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়েরও কোনো সমাধান করা হয়নি। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক বলছেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হবার পেছনে দুপক্ষেরই দায় ছিলো। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন-দুই পক্ষেই চুক্তি বিরোধী শক্তিশালী দুটি গ্রুপ ছিলো, যারা এই ঐকমত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

কারণ, দুই পক্ষই বলছিলো পুরো এলাকা তাদের এবং শুধু তাদেরই রাষ্ট্র হবে। গাজায় ইসরায়েলি হামলার তীব্রতা বেড়েই চলেছে দিন দিন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা পক্ষ হামলাকারীর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে।

ইসরায়েলি বাহিনী লাখো ফিলিস্তিনিদেরকে নির্বিচারে হত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো পরও পশ্চিমাদের অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। ইসরায়েলি দখল ও তাদের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের ব্যাপারে পশ্চিমারা এক সুরে কথা বলছে। গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধ চালানোর ন্যায্যতা হিসেবে সরবরাহ করা সেসব খবর মিথ্যা প্রমাণ হওয়ার পরও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। যদিও হোয়াইট হাউস খবরের সত্যতার ব্যাপারে তাদের অবস্থান দ্রুত প্রত্যাহার করে নেয়।

সংবাদমাধ্যমগুলো অযাচাইকৃত খবর প্রকাশের জন্য ক্ষমা চায়নি। প্রায় ৭৫ বছর ধরে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী সুনির্দিষ্ট অজুহাত ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছে অন্যায়ভাবে। ইসরায়েল সন্দেহাতীতভাবে গাজায় ব্যাপক গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এবং এর সংবাদমাধ্যমগুলো ইচ্ছাকৃতই চোখ বন্ধ করে রাখছে বলে মনে হচ্ছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা, মৃতদেহ পোড়ানো, মায়ের পেটের ভ্রূণ হত্যা, ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃতদেহ, মসজিদ, গির্জা, হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস করা এবং খাদ্য, পানীয় ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করার মতো নৃশংসতার পরও পশ্চিমা বিবেক সাড়া দিচ্ছে না।

ইসরাইলের উন্মাদনার অবসান তারা ঘটাতে চাইছে না বলেই মনে করা হচ্ছে। আল আহলি হাসপাতালে ইসরায়েলি বোমা হামলায় পাঁচ শতাধিক নিহত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যদিও কিছুটা মানবতাবাদী আচরণ দেখাতে চেয়েছিলেন; হাসপাতালে হামলার আগে প্রায় তিন হাজার ফিলিস্তিনি হত্যার ঘটনায় তিনি নীরব। তেল আবিব সফরের পর তার সাময়িক সরবতা আবার সাবেক নীরবতায় রূপ নিয়েছে। তিনি ইসরায়েলি যুক্তি গ্রহণ করে গাজায় চলমান গণহত্যা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশে বিরত রয়েছেন। ব্রিটেন ও ইউরোপের পাশাপাশি বাইডেন প্রশাসন ও ট্রাম্প প্রশাসন দৃশ্যত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছে।

বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে রাষ্ট্রটি ধ্বংসাবশেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত; তারা বিশ্বব্যাপী একাধিক গণহত্যা চালায়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ ইরাক ও আফগানিস্তান। জাতিসংঘে এবার দুটি প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর গাজা উপত্যকার মানুষদের হত্যা ও উচ্ছেদ কার্যক্রমের অনুমোদন হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। সেখানে যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ না করে, মানবিক সহায়তার অনুমতি না দিয়ে বরং ‘দখলকারী বাহিনীর আত্মরক্ষার অধিকার’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয় মা তাদের দ্বৈত নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করছে নিঃসন্দেহে বলা যায়। ইসলামী বিশ্ব ও আরব দেশগুলোও তেমনভাবে এগিয়ে আসছে না। তারা সৌদি আরব ও মিসরে সম্মেলন করেছে, বিবৃতি দিয়েছে এবং আমরা তীব্র কণ্ঠ শুনেছি, কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মিসর বলেছে, তারা ইসরায়েলের অনুমোদন ছাড়া রাফাহ ক্রসিং খুলতে পারবে না।

মিসর এবং আরো কয়েকটি দেশের পক্ষে রাফাহ ক্রসিং খোলার ঘোষণা দেয়া, সামরিক প্রহরায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি প্রদান, আহতদের সরিয়ে নেয়া এবং বেশি দেরি হওয়ার আগেই জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসক ও নার্স আনার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন । আপাত দৃষ্টিতে ৫৭টি আরব ও মুসলিম দেশের নেতাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করাটা অমূলক নয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তারা আকুতি জানাচ্ছে–‘এই যুদ্ধ বন্ধ করো’, ‘গাজাবাসীদের সাহায্য করো’। তারা মনে করছে, তাদের সরকারগুলো প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু তারা কি আদৌ সেটা করবে? গাজায় যখন গণহত্যা চলমান, এ অবস্থায় অলস বসে থাকা লজ্জাজনক। আমেরিকা প্রযোজিত ইসরায়েলি যুদ্ধ মেশিন থেকে গাজাবাসীকে রক্ষায় আমাদের সবাইকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। অন্যথায় পশ্চিমা বিশ্বের কুটকৌশলের কাছে নির্যাতিত হবে, মৃত্যুবরণ করবে নিরপরাধ মানুষ, নারী ও শিশু। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ইসরায়েলে ডানপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের সরকারও আর শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চায়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় দুই পক্ষের বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। এ সময় ইসরায়েল মূলত নজর দিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের ওপর এবং জেরুসালেমকে তারা ইসরায়েলের রাজধানীও ঘোষণা করেছে।

সবমিলিয়ে ফিলিস্তিনে এখন যে ভৌগলিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি-না তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবার আগে দরকার ভূখণ্ড। কিন্তু পশ্চিম তীর যেটা কি না ফিলিস্তিনের অংশ হবে সেখানে এখন কয়েক লাখ ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বসবাস করছেন। এ ছাড়া জেরুসালেমকেও ইসরায়েল তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং আমেরিকা সেটাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। ফলে ভৌগলিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন এখন আর বাস্তব সম্মত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক বলছেন, সুযোগ এখনো আছে। কিন্তু ইসরায়েল কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর চায়? লিটভ্যাক বলছেন, ইসরায়েল সেটা চায় না।

পরিস্থিতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। অতি সম্প্রতি গাজায় আরো নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। বিশ্বের মানচিত্র থেকে গাজা নামের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশ্ব মোড়ল দানবদের টনক নড়ছে না। এসো আওয়াজ তুলি ‘আর কোনো অপশন নাই, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই’।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

 

জনপ্রিয়