
আমাদের চিরায়ত সমাজ কাঠামোয় নারীকে দেখা হয় কন্যা, জায়া ও জননী, এই তিনটি ভূমিকায়। আবার কখনো বা দশভূজা। কিন্তু এই পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক করুণ বাস্তবতা। তা হলো শিশু নির্যাতন।
দেশে শিশুদের প্রতি সহিংসতা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও অবহেলা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতিবছর হাজারো শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়, যার বেশিরভাগই রিপোর্ট হয় না বা বিচারহীনতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। কিংবা আঁচল বা ওড়নার আড়ালে মিলিয়ে যায়।
বাংলা সাহিত্যে এবং সমাজ-সংস্কৃতির চিরন্তন বর্ণনায় নারী জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় বহন করে, কন্যা, জায়া ও জননী। এই তিনটি রূপ একে অপরের পরিপূরক এবং সামাজিক কাঠামোর মৌলিক ভিত্তি। একজন কন্যাশিশু বড় হয়ে হয় কারো সহধর্মিণী, আবার একজন জননী।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই রূপান্তরের পথে সে কতোটা নিরাপদ? বিশেষত, বর্তমান দেশে একজন কন্যাশিশুর শৈশব কতটা সুরক্ষিত? কন্যা, জায়া ও জননীর আত্মপরিচয় গঠনের শুরুতেই যদি নির্যাতন, অবহেলা ও সহিংসতা জড়িয়ে থাকে, তবে সমাজ হিসেবে আমরা কতটা সভ্যতার দাবি করতে পারি?
শিশু নির্যাতন আমাদের দেশের একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক ব্যাধি। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও কোনো শিশু শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ২০২৩ খিৃষ্টাব্দে একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই বছর ১ হাজার ৫০০-এর বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, যার মধ্যে একটি বড় অংশ কন্যাশিশু। অনেক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশেই আসে না চাপ, ভয়, কিংবা সামাজিক লজ্জার কারণে।
কন্যা, শৈশবেই বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার। ‘কন্যা’ শব্দটি অনেকের কাছে ভালোবাসার প্রতীক হলেও সমাজের বাস্তবতায় কন্যাশিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এক ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। অনেক পরিবারে এখনো পুত্র সন্তানকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, কন্যাশিশুকে বোঝা হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে কন্যাশিশু অনেক ক্ষেত্রেই পুষ্টি, শিক্ষা এবং সুরক্ষায় পিছিয়ে পড়ে।
শারীরিক শাস্তি, মানসিক নির্যাতন, এমনকি যৌন হয়রানি সবকিছুতেই তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে যৌন নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, অধিকাংশ সময় এই নির্যাতন ঘটে কন্যাশিশুর পরিচিত পরিমণ্ডলে আত্মীয়, শিক্ষক, প্রতিবেশী কিংবা পরিচিত বড়দের দ্বারা। এতে শিশুর শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস চুর্নবিচূর্ণ হয়। শৈশবের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তার জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলে।
একজন কন্যা যখন কৈশোরে প্রবেশ করে, তখন সে হয়ে ওঠে সমাজের চোখে ‘জায়া’ হবার প্রস্তুতিতে থাকা এক নারী। এ সময়েই কন্যাশিশুর জীবন আরো অনিরাপদ হয়ে পড়ে। বাল্যবিয়ে এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তোলে।
ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হওয়া নারীর হার প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়ে ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিবাহিত হয়। বাল্যবিয়ে কন্যাশিশুকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায় এবং তাকে পারিবারিক সহিংসতার চক্রে ঠেলে দেয়।
এ অবস্থায় তার স্বপ্নগুলো থেমে যায়, বন্ধ হয়ে যায় নিজেকে চিনে নেয়ার ও গড়ে তোলার পথ। সমাজ তাকে ‘জায়া’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, তার মনোজগৎ তখনো কন্যার মতোই আবেগপ্রবণ, স্বপ্নভরা এবং সহায়তা প্রত্যাশী থাকে।
জননী আত্মপরিচয়ের ভাঙা আয়নায় এক বিপর্যস্ত মা, একজন কন্যা যখন জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে মা হয়, তখন সে সমাজের কাছে জননীর স্বীকৃতি পায়। কিন্তু যদি শৈশবে সে নির্যাতনের শিকার হয়, যদি কৈশোরে তার স্বপ্ন ধ্বংস করা হয়, তবে এই জননীর মানসিক কাঠামো কতটা শক্তিশালী হতে পারে? অনেক সময় এই জননী আবার তার কন্যাশিশুকেও সেই একই শোষণের চক্রে ফেলে দেয় না জেনে, না বুঝে অথবা সমাজের চাপে। এভাবেই নির্যাতন ও অবহেলার এক দুষ্টচক্র তৈরি হয়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আহত করে চলে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ খিৃষ্টাব্দে ১ হাজার ৭০০-এর বেশি শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ যৌন নিপীড়নের শিকার, ৩০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ২০ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার। ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী ছিলো পরিচিতজন পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা প্রতিবেশী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর রিপোর্ট ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ১ হাজার ৫৪টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ১০ বছরের নিচে। বাল্যবিয়ের কারণে প্রায় ৫২ শতাংশ মেয়েশিশু উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনিসেফ-এর গ্লোবাল রিপোর্ট: বাংলাদেশে প্রতি ৫টি মেয়েশিশুর মধ্যে ১টি ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ের শিকার হয়।
৩৭ শতাংশ শিশু শারীরিক শাস্তির সম্মুখীন হয় বাড়ি বা স্কুলে। ইউনিসেফ-এর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১০ জন কন্যাশিশুর মধ্যে ৪ জন কোনো না কোনোভাবে শারীরিক বা মানসিক সহিংসতার শিকার হয়। আরো ভয়ের বিষয় হলো, ইউনিসেফ ও সেফ দি চিলড্রেন- এর যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, ৮৫ শতাংশ যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে শিশুর পরিচিতদের দ্বারা; আত্মীয়, প্রতিবেশী বা শিক্ষক। এদের বিরুদ্ধে শিশু বা তার পরিবার অধিকাংশ সময়ই মুখ খুলতে সাহস পায় না।
ইউনিসেফ- 2021 এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এখনো ৬৪ শতাংশ শিশুর ওপর শারীরিক শাস্তি দেয়া হয় ,যার একটি বড় অংশের ভুক্তভোগী কন্যারা, কারণ তাদের ‘নমনীয়’ ও ‘ভদ্র’ বানাতে পরিবার চেষ্টা করে শাসনের নামে নির্যাতন করতে।
দেশে বাল্যবিবাহের হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। ইউনিসেফের ২০২৩ খৃীষ্টাব্দ্ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ১৮ বছরের নিচে বিবাহিত নারীর হার ৫১.৪ শতাংশ এবং ১৫ বছরের আগেই বিবাহিত হয়েছে ১৫.৫ শতাংশ মেয়ে। এই হার আশঙ্কাজনকভাবে গ্রামীণ এলাকায় বেশি ।
বাল্যবিয়ে শুধু একজন মেয়ের শিক্ষার পথ রুদ্ধ করে না, তার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় বহুগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ১৫-১৯ বছর বয়সী মায়েদের মাতৃমৃত্যুর হার প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় ৪ গুণ বেশি। একই সঙ্গে এই মেয়েরা গৃহ নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন এবং মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা গৃহকর্তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় স্বামীর অধীনে নির্যাতনের শিকার হয়, যার বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। একজন নির্যাতিত কন্যা যখন মা হন, তখন তার মধ্যে একধরনের মানসিক ক্ষতের ছায়া পড়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারী শিশুকালে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, বিষণ্ণতা ও মাতৃত্বে জড়তা বেশি দেখা যায়। এভাবে নির্যাতনের এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়া চক্র গড়ে ওঠে।
শিশু নির্যাতনের পেছনে দায়ী প্রধান কারণসমূহ হলো পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, ছেলেকে শ্রেষ্ঠ এবং মেয়েকে বোঝা ভাবা। শিক্ষার অভাবে দারিদ্র্য, নির্যাতন, বাল্যবিয়ে এবং নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। আইনের দুর্বল প্রয়োগ বিচারহীনতা ও নির্যাতনকে উৎসাহিত করে চলেছে, সামাজিক ট্যাবু ও লজ্জা ভিকটিমদের নীরব থাকতে বাধ্য করছে। পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল অপরাধ শিশুদের ডিজিটাল হ্যারাসমেন্টের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
সরকার শিশু সুরক্ষায় বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে , শিশু আইন ২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০১১, তবে এসব আইনের প্রয়োগ ও নজরদারি এখনো দুর্বল। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে বিএসএফ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুর প্রতি সহিংসতা মামলার মাত্র ৯ শতাংশ রায় হয়েছে ভিকটিমের পক্ষে। অনেক মামলাই বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, অপরাধী পার পেয়ে যায়। সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে, পারিবারিক লজ্জা বা প্রতিশোধের ভয়ে অনেকে অভিযোগ করে না। আইনি জটিলতা, মামলা দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষী না থাকা বা পুলিশের অসহযোগিতা ও সমান ভাবে দায়ী। ডিজিটাল সাইবার ক্রাইমের শিকার শিশুদের অনেক অভিভাবকই বিষয়টি বুঝতে পারেন না বা রিপোর্ট করতে অনীহা দেখান।
শিশু নির্যাতনের পেছনে দায়ী পূর্বতন পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি, ছেলেকে শ্রেষ্ঠ এবং মেয়েকে বোঝা ভাবা। দারিদ্র্যকে নির্ভরশীল করে শিক্ষার অভাবে নির্যাতন ও বাল্যবিয়ে বেড়ে চলেছে, আইনের দুর্বল প্রয়োগে বিচারহীনতা নির্যাতনকে উৎসাহিত করছে। সামাজিক ট্যাবু ও লজ্জা ভিকটিমদের নীরব থাকতে বাধ্য করে, পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল অপরাধ সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুদের ডিজিটাল হ্যারাসমেন্টের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
শিশু, কন্যা ও জননী কে সুরক্ষিত রাখতে পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি বাবা-মায়েদের সচেতন করতে স্থানীয়ভাবে ওয়ার্কশপ, অভিভাবক সভা, টিভি প্রোগ্রাম চালু করা, বিদ্যালয়ে শিশু সুরক্ষা ক্লাব, শিশুদের অধিকার, সেলফ-ডিফেন্স ও মানসিক সহায়তা শেখানো, কমিউনিটি পর্যায়ে চাইল্ড প্রটেকশন কমিটি, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে, আইন প্রয়োগে জিরো টলারেন্স, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও হেল্পলাইন শক্তিশালী করা, মিডিয়া সচেতনতা ও ইতিবাচক প্রচার, নাটক, গল্প, ইউটিউব কনটেন্টে শিশু সুরক্ষাবিষয় গুলো তুলে ধরতে হবে সর্বোপরি সকলকে স্ব স্ব জায়গা থেকে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে।
‘কন্যা, জায়া, জননী’ এই তিনটি পরিচয়ের প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানের দাবিদার। একজন কন্যা যদি নির্যাতন ও অবহেলার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠে, তবে সে ভবিষ্যতে একজন সুখী জায়া বা আত্মবিশ্বাসী জননী হতে পারে না। তাই কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাকে ভালোবাসা ও মর্যাদার সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, এটা একটি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রগতির অন্যতম ভিত্তি।
আমরা যদি আজ আমাদের কন্যাদের শৈশব রক্ষা করতে পারি, তবে আগামীর জায়া হবে সহানুভূতিশীল জীবনসঙ্গী, আর জননী হবে দৃঢ়, সাহসী ও স্বপ্নবান প্রজন্মের নির্মাতা। শিশুরা কেবল আশার প্রতীক নয়, তারাই ভবিষ্যৎ সমাজের স্তম্ভ। তাই এখনই সময় কন্যাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করার, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার, এবং তাদের হাত ধরে একটি মানবিক, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলার।
শিশুকন্যাদের সুরক্ষিত রাখা মানেই আগামী প্রজন্মকে প্রস্তুত করা। কন্যাশিশুর উন্নয়ন, শিক্ষা, সুরক্ষা ও বিকাশ নিশ্চিত করা হলে, তারা সমাজকে আলোকিত করবে নিজেদের সত্তা দিয়ে। ‘কন্যা, জায়া, জননী’ এই পরিচয় যেনো হয়ে ওঠে গর্বের, সম্ভাবনার ও মানবতার প্রতিচ্ছবি।
লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত