ঢাকা সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫ , ৩০ চৈত্র ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বিসিএস পরীক্ষায় জট ও পেছানো

মতামত

মাছুম বিল্লাহ, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

বিসিএস পরীক্ষায় জট ও পেছানো

৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন’।। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগস্টের প্রথম দিকে এই পরীক্ষা হতে পারে। পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২৭ জুন এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো।

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিলো। এই বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার পদে ৩ হাজার ৪৮৭ জন এবং নন-ক্যাডার পদে ২০১ জনকে নিয়োগ দেয়ার কথা।

এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন পৌনে চারলাখ চাকরিপ্রার্থী। বর্তমানে চারটি বিসিএস পরীক্ষার জট লেগে গেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিসিএসের কার্যক্রম চলছে সাড়ে তিন থেকে চার বছর ধরে। এগুলোর মধ্যে ৪৪তম, ৪৫তম ও ৪৬তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। 

উপরোক্ত পরিস্থিতিতে বিদ্যমান চারটি বিসিএসের জট শেষ করে পরবর্তী সময়ে একেকটি বিসিএস এক বছরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা করছে বর্তমান পিএসসি কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষা বিদ্যমান পাঠ্যসূচিতেও পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে পিএসসি। প্রতিটি বিসিএসের জন্য পৃথক পৃথক রোডম্যাপও তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

৪৭তম বিসিএসের রোডম্যাপ অনুযায়ী মে মাসে প্রিলিমিনারী পরীক্ষা আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে সিনিয়র স্কেলের পরীক্ষার কারণে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময়সূচি পেছানো হতে পারে। গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে ৪৭তম বিসিএসের আবেদনগ্রহণ শুরু হয়েছে। পতিত সরকারের আমলের লিগ্যাসি হিসেবে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে চারটি বিসিএস পরীক্ষার জট খুলতে হচ্ছে।

এর মধ্যে ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো ওই আমলে। আর ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে।এর প্রিলিমিনারি হওয়ার কথা ছিলো ২৭ জুন থেকে। কিন্ত সেই পরীক্ষা পেছানোর জন্য চাকরিপ্রার্থীরা পিএসসির সামনে বিক্ষোভ করেছেন। পিএসসি কর্তৃপক্ষও তাদের দাবি অনুযায়ী পরীক্ষা পেছানোর কথা বলেছে।

পরীক্ষা পেছানে একটি জাতীয় ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। কিসের পরীক্ষা, কেনো পরীক্ষা, কি পরীক্ষা--এসব কোনো কিছুই বিবেচনায় না নিয়ে শিক্ষার্থী বা প্রার্থীদের দাবি ওঠে ‘পরীক্ষা পিছাতে হবে’। কেনো পেছাতে হবে তার কোনো যুক্তি নেই। পরীক্ষা পেছালে শিক্ষার্থী কিংবা চাকরি প্রার্থীদের কী লাভ হবে তাও তারা জানেন না, আবেগে সবাই পরীক্ষা পেছাতে চান আর কর্তৃপক্ষও সহজেই সকলে দাবি মেনে নেন। ফলে বিষয়টি যেনো মামুলী ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেছে।

তবে এটি সত্য যে, ৪৪তম বিসিএসের পুরো বিষয় চার বছরের শেষ হয়নি। ৪৫তম বিসিএস শেষ হয়েছে পনের মাস আগে কিন্তু ফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য।

এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি। এটির প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২৭ জুন হওয়ার কথা। সেটি পরিবর্তন করা হলো এবং এখন সম্ভবত আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীরা হয়তো চাচ্ছেন যে, পূর্ববর্তী পরীক্ষাগুলোর ফল ও নিয়োগ চূড়ান্ত করে পরবর্তী পরীক্ষা গ্রহন করতে হবে যাতে তাদের অযথা হয়রানির মধ্যে পড়তে না হয় বা ব্যস্ত থাকতে না হয়। এটির অবশ্য একটি যুক্তি আছে। সম্ভবত এই কারণেই পিএসসি তাদের দাবি মেনে নিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত পিএসসির নতুন প্রশাসন একেকটি বিসিএস পরীক্ষা এক বছরে শেষ করার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু পূর্ববর্তী তিনটি পরীক্ষা বকেয়া রেখে সেটি করা সম্ভব নয়। আগের জট খুলেই নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আমরা জানি, একটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ১০ থেকে ১২ হাজার প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য রাখা হয় যদিও প্রায় চার লাখের মধ্যে পরীক্ষার্থী এতে অংশ নেন। ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারী পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের বাছাই করা হয়। তারপর লিখিত পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক ও সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষা।

অর্থাৎ একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করতে পিএসসিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষকদের সহায়তা নিতে হয়। তারা আবার তাদের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক রুটিন ঠিক রেখে পিএসসিতে সময় দেন। সব মিলে বেশ সময় লেগে যায়। তাই পিএসসিকে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে দেড় বছরের মধ্যে বিসিএস পরীক্ষা শেষ করে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে বিসিএস পরীক্ষা শেষ করতে হবে এক বছরের মধ্যে। বাকি প্রায় ছয় মাসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ ও নিয়োগ শেষ করতে হবে। এ জন্য প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা বছরের কোন সময়ে হবে, তারও একটি বার্ষিক পঞ্জিকা নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন।

এই পরিকল্পনাকে আমরা স্বাগত জানাই। যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো তিন বিসিএসের জট। পিএসসি এই জট যতো দ্রুত খুলতে পারবে, ততো নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে। সেক্ষেত্রে ৪৪তম বিসিএসের বাকি প্রক্রিয়া অবিলম্বে শেষ করতে হবে। তারপর ৪৫ ও ৪৬তম পরীক্ষার সব ফর্মালিটি শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রার্থীদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। পরীক্ষা পেছানোর মানে হচ্ছে চাকরিপ্রার্থীদের অনিশ্চয়তা আরো ডেকে আনা।

কিছুসংখ্যক প্রার্থীর দাবির কারণে পরীক্ষা পেছানোর মানে হচ্ছে পরবর্তী সবগুলো পরীক্ষার ওপরই এর প্রভাব ফেলা। যেখানে সরকারি বহু দপ্তরে বহু পদ খালি পড়ে আছে দিনের পর দিন।

সেগুলো জটিলতার কারণে এবং বিসিএস পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রতার কারণে যথাসময় তো দূরের কথা বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও পদগুলো পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ওই সমস্ত জায়গাগুলোতেও জট বেঁধে থাকে কাজের। আর জনগণের সেবাপ্রাপ্তি তো পরের কথা। সে জিনিস তো আমাদের প্ল্যানিংয়েই থাকে না। শুধুমাত্র ব্যক্তির চাকরি হওয়াটাই প্রথম ধরে নেয়া হয়। সেটিতেও নানা ঝামেলা।

বর্তমানে বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, যার মধ্যে লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস অনুসারে সাধারন ক্যাডার, কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডারের প্রার্থীদের জন্য গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতায় ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংষ্কার কমিশন ছয়টি আবশ্যিক বিষয় অন্তর্ভূক্ত করে নম্বর পুনর্বণ্টনের সুপারিশ করে। কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলা, ইংরেজি রচনা, ইংরেজি কম্পোজিশন ও প্রেসিস, বাংলাদেশের সংবিধান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক ও চলতি বিষয়, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ ও পরিবেশ, ভূগোল প্রতি বিষয়ে ১০০ নম্বর করার সুপারিশ করেছে।

কিন্তু গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতায় যে ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিতে হতো তা এখন না রাখার সুপারিশ করেছে কমিশন। এই সুপারিশটি পরিবর্তনের দাবি রাখে। কারণ, হচ্ছে বিশ্বজুড়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা গণিত, পরিসংখ্যান ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের অবদান।

তাই ভবিষ্যতে যারা দেশের বড় দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাদের অবশ্যই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে আর তা গণিতের জ্ঞানের মাধ্যমেই সম্ভব। আমরা মনে করি বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় গণিত অবশ্যই থাকতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হয়, বিসিএসের চাকরিতে সরাসরি গণিতের কোন অ্যাপ্লিকেশন নেই কিন্তু বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্য এটি খুবই প্রয়োজন। কাজেই এটি বাদ দেয়া ঠিক হবে না।

সবশেষে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, বিসিএস একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এমন নয় যে, এখানে একটি কোর্স শেষ করা যায়নি বিভিন্ন কারণে তাই পরীক্ষা পেছাতে হবে। এখানে মুখস্থেরও কোনো বিষয় নয়। একজন প্রার্থীর জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্ঞান, কোনো বিষয় বিশ্লেষণের দক্ষতা এবং উপস্থিত বুদ্ধি কতোটা আছে এগুলো পরীক্ষা করার কথা। যদিও ট্র্যাডিশনালি এসব পরীক্ষাতেও মুখস্থ ও নকল দুটোই চলে।

এর ওপর আবার যুক্ত ছিলো তথাকথিত ‘কোটা’ পদ্ধতি। ফলে, আমরা যে ‘সিএসপি’ নামক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত আমলাদের দেখতাম সেটি এখন আর নেই কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া। কাজেই এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। বিসিএস কিংবা নন-বিসিএস যাই হোক না কেনো, প্রতিটি পদের কর্মকর্তাদের জনগণকে কীভাবে সেবা দিতে হবে তার সঠিক ও যুগোপাযোগী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে এসব চিন্তা করা হয় না। শুধু চাকরি দেয়া আর চাকরি পাওয়া বিষয়দুটোই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু কেন তারা এই চাকরিতে যাচ্ছেন, কাদের তারা সেবা দেবেন, কীভাবে দেবেন এসব ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসেনি। বর্তমান পিএসসি এবং যেসব মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগগুলোতে চূড়ান্ত প্রার্থীদের পদায়ন করা হবে তাদেরও এ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিসিএস পরীক্ষায় একটি অংশে এটি ভালোভাবে থাকা উচিত, একজন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হলে তার চয়েস অনুযায়ী যেসব বিভাগের জন্য নির্বাচিত হবেন সেখানকার কর্মক্ষেত্রে তিনি কীভাবে পরিবর্তন আনবেন, জনগণকে কীভাবে সেবা প্রদান করবেন সেই বিষয়টি ভালোভাবে থাকা উচিত। তাদের প্রশিক্ষনের মুখ্য উদ্দেশ্য হতে হবে তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক, তাদের প্রভু নন। এই বিষযগুলো চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত কোথাও উল্লেখ থাকে না। ফলে তারা চেয়ার দখল করার সঙ্গে সঙ্গে ‘বস’ হয়ে যান, জনগণের প্রভু হয়ে যান। পিএসসিসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে হবে।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

 

জনপ্রিয়