শিশুর আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় চার বছরের পর থেকেই। এ সময় স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে শুরু হয় এ শিক্ষা। শিশুর প্রথম শিক্ষা তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে। পরিবেশ থেকে অর্জিত জ্ঞান তাকে নিয়ে যায় বৃহত্তর পরিমণ্ডলে।
নিকট পরিবেশ থেকে সমৃদ্ধ জ্ঞান অর্জন করলে শিশু বেড়ে উঠবে আপন গতিতে। তাকে এগিয়ে দিতে হবে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সংগ্রামী ইতিহাসের হাত ধরে। এ ব্যপারে মূখ্য ভূমিকা রাখতে হবে শিশুর নিকট পরিবেশের অংশীজনদের।
বর্ণমালার গন্ডি পেরিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দেশপ্রেম, দেশের সংস্কৃতি-ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে এগোতে হবে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই তাদের ধর্মকর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে।
মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সম্পর্কে ভালোভাবে জানবে। সময়নিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সব ধরনের কলাকৌশল অন্তর্ভুক্ত করিয়ে সমৃদ্ধ পাঠ্যক্রমক প্রণয়ন করতে হবে।
উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা অনুকরণ করে আমাদের দেশের উপযোগী জ্ঞানমুখী শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম চালু করতে হবে। ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার মাধ্যম বিশেষ করে শিশুশিক্ষার্থীদের পরীক্ষাব্যবস্থা থেকে মুক্ত করতে হবে।
মুখস্থবিদ্যা পরিহার করে শিক্ষার্থীকে জ্ঞাননির্ভর শিক্ষায় আলোকিত করার উদ্দেশে বর্তমান শিক্ষাক্রমে চার প্লাস প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।
বিগত বছরগুলোর ন্যায় ১ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সব ভর্তি পরীক্ষা লটারির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এ ব্যবস্থা পরবর্তী বছরগুলোয় চালু থাকবে বলে আশাবাদী। ফলে আমাদের সমাজে ভর্তি বাণিজ্য শূন্যের কোটায় চলে আসবো।
ফলে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ও বিত্তশালীদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে অনেকটা ‘তেলা মাথায় তেল দেয়া’ সংস্কৃতির অসম প্রতিযোগিতার অবসান হবে।
ফলে বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন করিয়ে সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে হবে। জ্ঞান ব্যতিরেকে সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষাপটে শিশুর মাঝে সৃজনশীলতা বিষয়টির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে।
আমাদের শিক্ষার্থীরা বই দেখে রচনা মুখস্থ করার রীতিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। নিজের মতো করে বর্ণনা দিয়ে লিখার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনে জানার আগ্রহ ও কৌতূহল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে উত্তর বলা বা লেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার বিষয়টি উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। শিক্ষক প্রথমে পাঠের বিষয়বস্তু সর্ম্পকে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে ধারণা দেবেন। পরে তাদের মৌখিক প্রশ্ন তৈরি করতে বলবেন। অতঃপর পাঠ্যপুস্তক দেখে প্রশ্ন ও উত্তর খাতায় লিখতে বলবেন।
শিক্ষার্থীর ঘাটতি পূরণে শিক্ষক তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করবেন। শিক্ষক বর্তমানে যে প্রশ্নপত্র তৈরি করে বিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা নেন, সে আদলে শিক্ষার্থী প্রশ্ন তৈরি করে নিজে উত্তর লেখার মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করবে। এভাবে বহু নির্বাচনী প্রশ্নসহ প্রশ্ন তৈরির মাধ্যমে তাদের চিন্তাশক্তিসহ সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ, অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী ব্যতিরেকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শিশুশিক্ষার জন্য প্রথমত প্রয়োজন, শিশু মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। অথচ যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে শিশুশিক্ষায় বর্তমান শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবা দরকার। অন্যতায় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে বাধ্য।
স্বাধীনতার এতো বছর পরও শিশুদের শিক্ষক সংকট নিরসনে ধীরগতির কোনো পরিবর্তন আসেনি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকলেও শিক্ষক সংকটের বেহাল দশা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোসহ পরিবেশ এখন দৃষ্টিনন্দন ও মনোরম। অথচ শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকের হীনমন্যতার কারণে এটি হয়ে পড়েছে অনেকটা অন্তঃসারশুন্য।
প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো ক্যাডার সার্ভিসবিহীন প্রাথমিক শিক্ষা। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাবী, দক্ষ, অভিজ্ঞ জনবলের অভাব দেখা যায়। দীর্ঘ ৩৩ বছর আগে স্বতন্ত্র প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ৪৪ বছর আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠিত হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় আজও কোনো নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস গড়ে ওঠেনি। যারপরনাই প্রাথমিক শিক্ষায় স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত সর্বোচ্চ পর্যায়ে অধিকাংশ কর্মকর্তা বদলি ও প্রেষণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত থাকায় তারা তাদের নিজস্ব ক্যাডারের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অর্জিত অভিজ্ঞতা যথাযথ প্রয়োগ করার পর্যাপ্ত সুযোগ পান না।
অধিকন্তু প্রেষণে নিয়োজিত এসব কর্মকর্তাকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলার পর প্রাথমিক শিক্ষাবহির্ভূত অন্যত্র প্রত্যাবর্তন বা পদায়নের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কোনো প্রতিফলন ঘটানো অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।
বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্যাডারের সদস্য না হওয়ায় তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যারিয়ার নেই। তাদের অধিকাংশই যে পদে চাকরি শুরু করেন, সে পদে থেকেই অবসরগ্রহণ করে থাকেন। ফলে তাদের মধ্যে কর্ম উদ্দীপনা হ্রাস পেতে থাকে। যা প্রাথমিক শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
দেশে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৭৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োজিত। তাদের মধ্যে ২৫৪১ জন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা।
দেখা যায় বাকি প্রায় ১০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ২৬টি (সাধারণ ক্যাডার ১৪টি কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডার ১২) ক্যাডার সার্ভিস বিদ্যমান আছে। অথচ প্রায় ৫ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র কোনো ক্যাডার সার্ভিস নেই। ফলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করে মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে না।
প্রাথমিক শিক্ষায় আলাদা ক্যাডার সার্ভিস ও উন্নত ক্যারিয়ার সুযোগ না থাকার কারণে উচ্চশিক্ষিত প্রতিভাবান, চৌকশ ব্যক্তিরা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে আকৃষ্ট হচ্ছে না। একই কারণে ১৩তম গ্রেডের সহকারী শিক্ষকের পদে যোগদানের পরও দেখা যায় অন্যদপ্তরে ১৭তম গ্রেডে চাকরি হলেও চলে যায় ।
এ কার্যক্রমের সঙ্গে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ জনের অধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষায়, যা দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দুই-তৃতীয়াংশের জন্য ২৬টি বিসিএস ক্যাডার থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো বিসিএস ক্যাডার নেই। প্রাথমিক শিক্ষার এ ব্যাপক কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই বিসিএস প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস গঠন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস গঠিত হলে কর্মকর্তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং উচ্চশিক্ষিত, প্রতিভাবান ব্যক্তিরা এ সেক্টরে যোগদানে জন্য উৎসাহিত হবেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা জন আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।
লেখক: শিক্ষক ও কলাম লেখক
