
ফিলিস্তিনের জেরুসালেম নগরীতে অবস্থিত বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মসজিদুল আকসার কথা তুলে ধরেছেন। এখান থেকেই সংঘটিত হয়েছিলো আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মেরাজ। তাই আমরা এখানে পবিত্র মসজিদে আকসা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরছি।
পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ
মসজিদে আকসা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ। মসজিদে হারামের পরেই এই মসজিদ স্থাপিত হয়। হজরত আবু যর (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদ স্থাপিত হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, এরপর কোন মসজিদ? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। বললাম, এই দুইয়ের নির্মাণের মাঝে কত সময়ের ব্যবধান? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। (বুখারি শরিফ: ৩৩৬৬, মুসলিম শরিফ: ৫২০)
বরকতময় মসজিদ, বরকতপূর্ণ ভূমি
মসজিদে আকসার একটি বিশেষ ফজিলত হল, আল্লাহ একে বরকতময় করেছেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে আশপাশের জনপদকেও বরকতপূর্ণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর শ্রোতা, সব কিছুর জ্ঞাতা। (সুরা বনী ইসরাইল: ১)
তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ
ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ মসজিদে হারাম, যা পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত। দ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ মসজিদে নববী, যা মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত। তৃতীয় পবিত্রতম ও শ্রেষ্ঠতম মসজিদ হল মসজিদে আকসা, যা ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নগরীতে অবস্থিত। এ কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: সফর করলে তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা উচিত। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসা। (বুখারি শরিফ: ১১৮৯; মুসলিম শরিফ: ১৩৯৭)
এই হাদিস প্রমাণ করে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর পরেই মর্যাদার দিক থেকে মসজিদে আকসার অবস্থান।
মুসলিমদের একসময়ের কেবলা
মসজিদে আকসার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এটি মুসলিম উম্মাহর একসময়ের কেবলা। হজরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন প্রথম মদীনায় এলেন, তাঁর মামাদের বাড়িতে মেহমান হলেন। আর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে ১৬ থেকে ১৭ মাস পর্যন্ত নামাজ আদায় করেছেন। তবে তিনি চাইতেন বাইতুল্লাহ যেন তাঁর কেবলা হয়। (বুখারি: ৪০, মুসলিম শরিফ: ৫২৫)
ইসরা ও মেরাজের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ
মসজিদে আকসার গুরুত্ব বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, মেরাজ রজনীতে আমাদের নবীজি ঊর্ধ্বজগতের সফর শুরু করার পূর্বে জিবরীল আমীনের সাথে প্রথমে এই মসজিদে এসেছেন এবং সকল নবীরাসুলকে নিয়ে নামাজ আদায় করেছেন।
একটি দীর্ঘ হাদিসের বর্ণনায় হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: অতঃপর আমি বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলাম। সমস্ত নবীদেরকে একত্রিত করা হল। জিবরীল আমাকে সামনে এগিয়ে দিলেন আর আমি তাঁদের ইমামতি করলাম। (সুনানে নাসায়ী: ৪৪৯)
হাশরের ময়দান
বাইতুল মুকাদ্দাসের গুরুত্ব এখান থেকেও বোঝা যায় যে, কিয়ামতের দিন এটাই হবে হাশরের ময়দান। হযরত মাইমুনা (রা.) বলেন: হে আল্লাহর রাসুল! আমাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন এটা হবে হাশরের ময়দান। এখান থেকে মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে যাবে। তোমরা এখানে আসো এবং নামাজ আদায় করো। (মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৭০৮৮)
মসজিদে আকসায় নামাজের সওয়াব
মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর পাশাপাশি মসজিদে আকসায় নামাজ পড়ার সওয়াবও অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। হজরত আবুদ দারদা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মসজিদে হারামের নামাজ এক লক্ষ নামাজের সমতুল্য। আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) নামাজ এক হাজার নামাজের সমতুল্য। আর বাইতুল মুকাদ্দাসের নামাজ পাঁচশ নামাজের সমতুল্য। (মুসনাদে বাযযার (কাশফুল আসতার): ৪২২; বায়হাকী শরিফ: ৩৮৪৫)
মসজিদে আকসা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা করার সাওয়াব
এক পবিত্র ভূখণ্ড থেকে আরেক পবিত্র ভূখণ্ডে সফর করা কতইনা আনন্দ ও সৌভাগ্যের বিষয়। এ কারণে হাদিস শরিফে মসজিদে আকসা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। হজরত উম্মে সালামাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা করবে, তার গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩০০১)
সত্যপন্থীদের অবস্থানস্থল
বাইতুল মুকাদ্দাস এবং আশপাশের অঞ্চলে সর্বদা এমন একটি দলের উপস্থিতি থাকবে, যারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আবু উমামা বাহিলী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সত্যের ওপর অবিচল থাকবে। তাদের দুশমনদের ওপর বিজয়ী থাকবে। দুঃখ কষ্ট ও ক্ষুধার যন্ত্রণা ছাড়া বিরোধীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ আসবে আর তারা এভাবেই থেকে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এই দলটির অবস্থান কোথায় হবে? তিনি বললেন, বাইতুল মুকাদ্দাস ও তার আশেপাশে। (মুসনাদে আহমাদ: ২২৩২০)
হক-বাতিলের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণী লড়াই
মানবজাতির যাত্রালগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে হক ও বাতিলের লড়াই, সত্য ও মিথ্যার সংঘাত। এই সংঘাত অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে হক-বাতিলের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণী লড়াই হবে বাইতুল মুকাদ্দাস অঞ্চলে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কিয়ামত হবে না যতক্ষণ না মুসলিমগণ ইহুদিদের সাথে লড়াই করবে এবং তাদের হত্যা করবে। এমনকি ইহুদিরা যে পাথর বা গাছের পেছনে আত্মগোপন করবে, সে পাথর বা গাছও বলে উঠবে, হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দা! এই যে আমার পেছনে ইহুদি আছে। এসো, তাকে হত্যা করো। তবে গারকাদ গাছ কিছু বলবে না; কারণ এটা ইহুদিদের গাছ। (মুসলিম শরিফ: ২৯২২; বুখারি শরিফ: ২৯২৬) ইমাম নববী (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘গারকাদ’ এক ধরনের কাঁটাযুক্ত গাছ, যা বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রচুর পরিমাণে হয়। আর সেখানেই দাজ্জাল ও ইহুদি বধের ঘটনা ঘটবে।
উপরের আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, আল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ আর মুসলিম উম্মাহর জন্য কতই না গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গোটা মুসলিম উম্মাহ আল আকসার বিষয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।
আল্লাহ আমাদের মাফ করুন এবং আল আকসার মুক্তির জন্য আবারো জেগে ওঠার তাওফিক দান করুন।
লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ