
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ করে যারা একাডেমিয়ায় ক্যারিয়ার গড়তে চায় অথবা নিজের সাবজেক্টের প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে সেই ফিল্ডেই একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে আগ্রহী কিংবা নিজের ফিল্ডেই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্য গবেষণা একটি অপরিহার্য অধ্যায়। সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করেই আমার এ লেখা।
প্রথমেই একটি কথা বলে রাখা উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সকল শিক্ষার্থীর জন্যই একটি অমূল্য সম্পদ। গবেষণা শুধু একটি মাত্র নির্দিষ্ট পেশার জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামগ্রিকভাবে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এগুলো হলো-
১. গবেষণায় সাইটেশন দ্বারা আমরা অত্যন্ত শিক্ষণীয় একটি বার্তা পাই, সেটি হল অন্যের কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও যথেষ্ট শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। গবেষণায় আমরা সাইটেশনের মাধ্যমে অন্যের অবদানকে স্বীকৃতি দেই, অর্থাৎ আমরা যাদের কাজ বা পাবলিকেশন থেকে জ্ঞান অর্জন করি, তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করি। এটি ব্যক্তিজীবনে নৈতিকতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এটি শুধু একাডেমিক চর্চার একটি নিয়ম নয় বরং এটি একজন ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব।
২. গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী জটিল থেকে জটিলতর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে, যা যেকোনো কর্মক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম করে তোলে।
৩. গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কারণ, গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন স্কলারদের সামনে সুনিপুণভাবে উপস্থাপন এবং ব্যাখ্যা করতে হয়।
৪. গবেষণার মাধ্যমে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় যা যেকোনো পেশায় অপরিহার্য।
৫. গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিক প্রবন্ধ লেখার দক্ষতা অর্জন করে, যা ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া, কোলাবোরেটিভ রিসার্চ দলগত কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
তাই ‘নিজের সাবজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশায় জব না করলে গবেষণার প্রয়োজন নেই’-এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি ধারণা। গবেষণা সামগ্রিকভাবে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং এই একটি কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশনের শেষ বর্ষে গবেষণায় উৎসাহিত করা হয় এবং থিসিস লিখতে বলা হয়।
এবার আসি মূল বিষয়ে। একটি রিসার্চে মানসম্মত কাজ করার মাধ্যমে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সেই কাজটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্লাটফর্ম অর্থাৎ উপযুক্ত জার্নাল নির্বাচন করে প্রকাশ করাটাও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু, রিসার্চ টপিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাল মানের জার্নাল যেমন খুঁজে বের করতে হবে, ঠিক একই সঙ্গে কোন জার্নাল প্রিডেটরি সেটাও বুঝতে হবে। তবে ভালো এবং খারাপ জার্নালের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়ে যায় এক ধোঁয়াশার মধ্যে, যেখান থেকে তারা সহজে বের হতে পারে না শুধুমাত্র সঠিক গাইডলাইনের অভাবে। বলছি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা এবং সেটি হল জার্নালের কোয়ার্টাইল অর্থাৎ Q1, Q2, Q3, Q4। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা কোয়ার্টাইল (Q1, Q2, Q3, Q4) নিয়ে মাতামাতি করলেও প্রকৃত অর্থে তারা এটাই জানে না যে Q1, Q2, Q3, Q4 জার্নাল আসলে কী।
আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রচলিত মতামত এটাই যে ‘Q1 জার্নাল সর্বোচ্চ মানের জার্নাল, যেখানে হাই কোয়ালিটি রিসার্চ পেপার পাবলিশ হয় এবং পাবলিশ করাও অত্যন্ত কঠিন। অপরদিকে, Q4 জার্নাল নিম্ন মানের জার্নাল, যেখানে নিম্ন মানের রিসার্চ পেপার পাবলিশ হয় এবং পাবলিশ করা অনেক সহজ’-এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল এবং বিভ্রান্তিকর।
কোয়ার্টাইল হল জার্নালের একটি শ্রেণিবিন্যাস যা মূলত জার্নালগুলোর সাইটেশন এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর। এর ওপর ভিত্তি করে জার্নালকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে। অর্থাৎ এই শ্রেণি ব্যবস্থায় সাইটেশন সংখ্যা ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে জার্নালের তুলনা করা হয়। আবার সাইটেশন ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের সমস্ত বিষয়টি নির্ভর করে জার্নালটির গ্লোবাল রিচ, জার্নালের রেগুলারিটি ও স্ট্যাবিলিটি এবং ব্লাইন্ড রিভিউ, যা প্রতিষ্ঠিত পাবলিশারের প্রায় সব জার্নালেই বজায় থাকে, পদ্ধতির ওপর।
ব্যাপারটা আরো সহজ করে বলি, Q1 জার্নাল সাধারণত অধিক সাইটেশন ও ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর পায়। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরে পেপার প্রকাশিত করে আসছে। অপরদিকে, Q4 জার্নালগুলোর বয়স তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে এদের পরিচিতি কম হতে পারে বিধায় তাদের পেপারের সংখ্যাও কম হয়। ফলস্বরূপ, Q4 জার্নালগুলো তুলনামূলক কম সাইটেশন ও নিম্ন ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর গ্রহণ করতে পারে। একটি জার্নালের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকাশিত রিসার্চ পেপারের সংখ্যা এবং সাইটেশন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ, জার্নালটির Q2, Q1 কোয়ার্টাইলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তবে নতুন জার্নালের ক্ষেত্রেও মানসম্মত রিসার্চ পেপার প্রকাশের পাশাপাশি যদি সময়ের সঙ্গে সাইটেশন সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেটিও Q2, Q1 কোয়ার্টাইলের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। আবার জার্নালের বয়স বেশি হলেই যে সেটি Q1, Q2 কোয়ার্টাইলে থাকবে বিষয়টি এমনও নয়। অনেক সময় দেখা যায় কোনো জার্নাল দীর্ঘকাল ধরে মানসম্মত পেপার পাবলিশ করে আসার পরেও অধিক সাইটেশন ও ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর মনে করে না। ফলে, জার্নালটি Q2 বা Q1 কোয়ার্টাইলে থাকে না।
কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জার্নাল Q1 হোক অথবা Q4, রিভিউ সিস্টেম সর্বত্রই সমান থাকে। অর্থাৎ রিসার্চ পেপার যখন রিভিউ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়, তখন সেটি কখনোই জার্নালের কোয়ার্টাইল দেখে মূল্যায়ন করা হয় না, বরং মূল্যায়ন করা হয় রিসার্চ পেপারের গুরুত্বপূর্ণ দিক সঠিকতা, এবং সমাজে সেটির প্রভাব ও গুরুত্ব বা কার্যকারিতার ওপর। Q1 থেকে Q4 সব কোয়ার্টাইলেই মানসম্মত পেপার প্রকাশ হতে পারে। Q1 জার্নালগুলো সাধারণত বিস্তৃত পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পারে এবং সাইটেশন সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হয়। আবার Q4 জার্নালেও উচ্চমানের গবেষণা পাবলিশ হতে পারে এবং তুলনামূলক কম সাইটেশনের কারণে সেটি Q4 এ থাকতে পারে। জার্নালের অবস্থান বা বয়স যেমনই হোক না কেনো, একটি স্বচ্ছ ও কার্যকর রিভিউ পদ্ধতি সর্বত্রই সমানভাবে প্রযোজ্য থাকে। অনেক সময় রিসার্চ পেপারের বিষয়বস্তু ও ফলাফল কিছুটা জটিল ও দুর্বোধ্য হয়, যার ফলে সাধারণ পাঠকদের সেটি বোধগম্য হয় না। ফলে সেই গবেষণাগুলো উচ্চমানের হওয়া সত্ত্বেও সাইটেশন সংখ্যা কম হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিংবদন্তি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর বিশ্বকে বিস্মিত করে দেয়া রিসার্চ পেপার ‘Local observation in eternal inflation’- এ স্থানীয় পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের কাঠামো ও সঠিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু এই রিসার্চ পেপারটির গুগল স্কলার অনুযায়ী বর্তমান সাইটেশন সংখ্যা মাত্র ৪৯টি। পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর আরেকটি বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা ‘The Illustrated Theory of Everything: The Origin and Fate of the Universe’- বইয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, কৃষ্ণগহ্বর এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি তার তত্ত্বগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যা পুরো পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত কারণ এটি মহাবিশ্বের মূল কাঠামো ও প্রসারণ প্রক্রিয়া বুঝাতে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। অথচ, গুগল স্কলার অনুযায়ী এই বিশ্বখ্যাত বইটিরও বর্তমান সাইটেশন সংখ্যা মাত্র ১৬টি। অর্থাৎ, গবেষণার গুণগত মান এবং গভীরতা সব সময় সাইটেশন সংখ্যা বা ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ, বিশ্বমানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সাধারণভাবেই কিছুটা জটিল ও দুর্বোধ্য হতে পারে, কেনোনা সেগুলো গভীর তাত্ত্বিক ধারণা এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়।
এটি অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, রিসার্চ পেপারের মানের চেয়ে জার্নালের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাবের একটি তুলনামূলক নির্দেশক হলো কোয়ার্টাইল। একটি গবেষণার গুণগত মান ও অবদান বিবেচনা করতে হলে জার্নালের কোয়ার্টাইল নয়, গবেষণার মৌলিকত্ব, বিশ্লেষণ এবং বাস্তব জীবনে এর প্রভাবকে মূল্যায়ন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান অন্তর্বর্তী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধিকাংশ গবেষণা একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ডিজিটাল লাইব্রেরি রিপোজিটরি প্লাটফর্ম এবং পলিসি রিপোর্ট আকারে বেশি প্রকাশ পেয়েছে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের এই গবেষণাগুলো কোয়ার্টাইল জার্নালে পাবলিশ না করা সত্ত্বেও সেগুলোর বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা অসামান্য এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দেয়ার মতো প্রভাব ফেলেছে।
সুতরাং, জার্নালের কোয়ার্টাইল তথা সাইটেশন এবং ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর গবেষণার গুণগত মানের একমাত্র পরিমাপক নয়। গবেষণার প্রকৃত মূল্য কোয়ার্টাইল দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বাস্তব জীবনে সেটির প্রভাব এবং সমাজ বা বিশ্বে অবদানের মাধ্যমেই তা মূল্যায়িত হয়। তাই Q1 বা Q2 জার্নাল নিয়ে ভীতি বা বিভ্রান্তি তৈরি না করে সঠিক তথ্য নিজে জানুন এবং অন্যদের জানার সুযোগ করে দিন। একটি জার্নালের Q ক্যাটাগরি সেই জার্নালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে এটি কোনো গবেষণার মান বা গুরুত্ব নির্ধারণের একমাত্র মানদণ্ড নয়। যদি আপনার রিসার্চ পেপার Q4 জার্নালে প্রকাশিত হয়ে থাকে, তাতেও আপনি শতভাগ আত্মবিশ্বাসী থাকতে পারেন যে আপনার গবেষণা Q1 জার্নালে প্রকাশ করার সক্ষমতা হয়ে গিয়েছে। মনে রাখবেন, Q1 বা Q4, যে কোনো শ্রেণির জার্নালে প্রকাশনার জন্য আপনার একই কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। ‘Q1 জার্নালে গবেষণা প্রকাশের জন্য বেশি পরিশ্রম এবং Q4-এ কম পরিশ্রম প্রয়োজন’- এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন এবং সঠিক তথ্য প্রদান করে অন্যদেরও গবেষণায় উৎসাহিত করুন।
লেখক: পিএইচডি গবেষক (বুয়েট)