ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ , ৫ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বাংলাদেশের তিন বিশ্ব ঐতিহ্য

মতামত

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

বাংলাদেশের তিন বিশ্ব ঐতিহ্য

আজ ১৮ এপ্রিল ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা তৈরি শুরু করে।

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ তিউনিশিয়ায় একটি আলোচনা সভায় ১৮ এপ্রিলকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ বা বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরের বছর এটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮ এপ্রিল দিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে পালিত হয়েছে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের তাগিদ থেকে দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ইউনেসকো স্বীকৃতি তিনটি বিশ্ব ঐহিত্য রয়েছে। যথা: ১. ষাট গম্বুজ মসজিদ ২. পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও ৩. সুন্দরবন।

ষাট গম্বুজ মসজিদ: বাগেরহাট জেলার ষাট গম্বুজ মসজিদ শুধু বাংলাদেশের নয় এটি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বাগেরহাটের ঐতিহাসিক স্থাপনাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়।

সাত লাইনে ১১টি করে ৭৭টি এবং চার কোনায় ৪টিসহ সবমিলিয়ে ষাট গম্বুজ মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১টি। জানা যায়, সাতটি করে সারিবদ্ধ গম্বুজ থাকায় এর নাম সাত গম্বুজ! সেখান থেকে এর নাম ষাট গম্বুজ মসজিদ।

আবার অনেকে মনে করেন, গম্বুজগুলো ৬০টি স্তম্ভের উপর অবস্থিত বলে কালক্রমে এটি ষাট গম্বুজ নাম ধারণ করেছে। কালের বিবর্তনে লোকমুখে ৬০ গম্বুজ বলতে বলতে ষাট গম্বুজ নামকরণ হয়ে যায়, সেই থেকে এটি ষাট গম্বুজ নামে পরিচিত। কবে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি তৈরি হয়েছিলো তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এর স্থাপত্যশৈলী স্বাক্ষ্য দেয় যে, মসজিদটি ১৫০০ শতাব্দীতে নির্মিত। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। মসজিদের চারকোনে গোলাকার চারটি মিনার আছে। প্রতিটি মিনারের চূড়ায় একটি করে গম্বুজ রয়েছে।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার: ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো ‘পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার’কে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। যদিও এর নাম আগে ছিল সোমপুর মহাবিহার। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর বানগড়-এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিলো সোমপুর মহাবিহার।

এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ইউনেসকোর মতে, পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বৌদ্ধবিহার দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।

পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। সম্রাট ধর্মপাল অনেক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ছিলেন। তিনিই বিক্রমশীলা ও সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। আবার বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ থেকে তথ্য পাওয়া যায়, ধর্মপালের পুত্র দেবপাল সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দির তৈরি করেছেন। উল্লেখ্য, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন।

উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, সোমপুর মহাবিহার প্রাচীন বাংলার অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। পাল রাজবংশের অধীনে নির্মিত এই মহাবিহার জ্ঞান, ধর্ম ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে সুনাম কুঁড়িয়েছিলো। তবে ১১’শ থেকে ১৩’শ শতকের মাঝে একাধিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রভাবে এই সমৃদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়।

সুন্দরবন: ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। যার আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বিশাল এই সুন্দরবনের ৬ হাজার ৫১৭ বর্গ কিলোমিটার (প্রায় ৬৬ শতাংশ) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (প্রায় ৩৪ শতাংশ) রয়েছে ভারতের মধ্যে।

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি। যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলোর একটি। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত।

সুন্দরবনে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপমালা। সুন্দরবনের মোট বনভূমির প্রায় ৩১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিলসহ জলাকীর্ণ অঞ্চল। এই বনে ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতিসহ ৪৫৩টি প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থান রয়েছে।

গাছের প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গাছ হলো সুন্দরী এবং গেওয়া। সুন্দরবনে আরো যেসব উদ্ভিদ জন্মে এর মধ্যে রয়েছে-কেওড়া, গোলপাতা, গরান, বাইন, ধুন্দুল, পশুর, প্রভৃতি। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়, সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে। সুন্দরবন স্থানীয়ভাবে বাদা বা হুলোবন, শুলোবন, মাল, মহাল হিসেবে পরিচিত। বাদা মানে জোয়ার-ভাটা বয়ে যায় যে বনে।

সুন্দরবনে নানা প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জলে রয়েছে কুমির, হাঙর প্রভৃতি। স্থলে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, সজারু, শেয়াল, নানা ধরনের পাখি, মৌমাছি, বন মোরগ ইত্যাদি। এটি বিশ্বের বিরল বাদাবন (ম্যানগ্রোভ)। অজস্র নদ-নদী ও জলজ প্রাণীকুল, বিশাল অরণ্য, অসংখ্য প্রাণী ও জৈবসত্তা মিলিয়ে সুন্দরবন এক মহাপ্রাণব্যবস্থা।

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সুন্দরবন ব্যাপকভাবে জড়িয়ে আছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে তুলে ধরে বা বাংলাদেশকে চেনে এমন পাঁচটি বিষয়ের তালিকা করলে সুন্দরবন সে তালিকায় থাকবে। বাংলাদেশের গর্ব এই সুন্দরবন। সম্প্রতি ইউনেসকো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে বিশ্বের জন্য অসামান্য সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণী হলো বয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ। বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, সুন্দরবনে ১২৫টি বাঘ রয়েছে। সুন্দরবনের আশপাশের জনসংখ্যা ৪ মিলিয়নের বেশি কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়। মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক উভয় কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু সমস্যায় ভুগছে সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে তো বটেই জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

লেখক: শিক্ষক

 

জনপ্রিয়