ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ , ৫ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

শিশুর চরিত্র গঠনে মক্তব

মতামত

মাহবুবুর রহমান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

শিশুর চরিত্র গঠনে মক্তব

শিশুরা ফুলের মতো। যত্নে, স্নেহে, ও সঠিক নির্দেশনায় তাদের বিকাশ ঘটে। শিশুদের চারিত্রিক গঠনের মাধ্যমে একটি সভ্য, নৈতিক ও উন্নত সমাজ গঠনের ভিত্তি স্থাপন করা যায়। ইসলামী পরিভাষায়, শিশুদের নৈতিক শিক্ষা এবং চারিত্রিক বিকাশের সূচনা ঘটে মক্তব নামক প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

মক্তব কেবল একটি পড়ার স্থান নয়; বরং এটি আদর্শ মানুষ তৈরির সূতিকাগার। এখানে শিশুরা কোরআনের শিক্ষা, নামাজ, দোয়া, আদব, নৈতিকতা, ও সুস্থ আচরণের মৌলিক পাঠ গ্রহণ করে, যা তাদের সারাজীবনের আচার-আচরণ ও জীবনদর্শনে গভীর প্রভাব ফেলে। 

‘মক্তব’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘কুতুব’ থেকে, যার অর্থ লেখা। ঐতিহাসিকভাবে, মুসলিম সমাজে মক্তব হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে শিশুদের কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি মূল্যবোধে গড়ে তোলা হয়। এই উপমহাদেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মক্তব শত শত বছর ধরে একটি নির্ভরযোগ্য শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মক্তবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- এটি সাধারণত মসজিদকেন্দ্রিক হয়, যেখানে একজন শিক্ষক শিশুদের কোরআন, হাদিস, দোয়া, নামাজ এবং ইসলামি আদর্শ শেখান।

চারিত্রিক গঠন কী? চারিত্রিক গঠন বলতে শিশুর চিন্তা, আচরণ, মূল্যবোধ ও নীতিবোধ গঠনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার ভিত্তিতে সে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সৎ-অসৎ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং আচরণ গড়ে তোলে। চারিত্রিক গঠন হচ্ছে আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের একটি অপরিহার্য ধাপ।

শিশুকালের চারিত্রিক গঠন কেনো গুরুত্বপূর্ণ? শিশু বয়স হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও গ্রহণক্ষম সময়। এই সময়েই তার মন ও চিন্তা সহজে গঠিত হয়। ভালো নৈতিক গুণাবলি যেমন- সত্যবাদিতা, সহানুভূতি, ধৈর্য, পরোপকার ইত্যাদি যদি এই বয়সে শেখানো যায়, তা সারা জীবন স্থায়ী হয়।

শিশুর মধ্যে আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস, দায়িত্ববোধ ও নিয়মানুবর্তিতা গড়ে ওঠে তার চারিত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে। এই শিক্ষাই ভবিষ্যতে তাকে সৎ, সাহসী ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থানকারী একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। একটি সমাজে যদি অধিকাংশ শিশু সৎ, বিনয়ী, দায়িত্বশীল ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে বড় হয়, তবে সেই সমাজে সহিংসতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার হার কমে যায়।

ইসলামে চারিত্রিক গঠন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল, এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করবে।’ এই হাদিস প্রমাণ করে, সন্তানদের সঠিক পথে গড়ে তোলা পিতামাতার দায়িত্ব এবং এই কাজের শুরুটা হয় শিশু বয়স থেকেই। রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, ‘একজন ইমানদার মুমিন তার উত্তম চরিত্রের মাধ্যমেই রোজার ও নামাজের মর্যাদা লাভ করতে পারে।’ অতএব, বাহ্যিক আমলের পাশাপাশি চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টিও ইসলামে সমভাবে গুরুত্ব পায়।

শিশুর চারিত্রিক গঠনের মূল নিয়ামক তার পরিবার। বাবা-মায়ের চরিত্র, আচরণ, শেখানোর ধরন এসব কিছুই শিশু অনুকরণ করে। এরপরে মক্তব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা চর্চা শেখানো হয়।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ও আফ্রিকার গ্রামীণ অঞ্চলে মক্তব শিক্ষা এখনো শিশুদের মধ্যে বিশুদ্ধ নৈতিক ভিত্তি গঠনে ভূমিকা রাখছে। অনেক পরিবারে দেখা যায়, যারা নিজেদেরকে পুরোপুরি দ্বীনি শিক্ষা দিতে পারেন না, তারা অন্তত সন্তানকে মক্তবে পাঠিয়ে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হন যে, সন্তান সঠিক পথে বড় হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু প্রাথমিক পর্যায়ে মক্তবে গিয়েছে, তারা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে মিথ্যা বলা, গালমন্দ, ও অসদাচরণের প্রবণতা থেকে অনেকাংশে দূরে থাকে।

তবে অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষক নিজেই শিশুবান্ধব পদ্ধতিতে পাঠদান করতে পারেন না। শিশুদের বয়স অনুপযোগী পাঠ্যসূচির কারণে তারা পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমনকি অনেক মক্তবে ভালো বসার জায়গাও নেই।

মক্তবে এখন শিশু মনোবিজ্ঞান ও দ্বীনি শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে ইর্ন্টারঅ্যাকটিভ ও আনন্দময় পাঠ্যক্রম তৈরি করে শিশুর আগ্রহ বৃদ্ধি করা যায়। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে পঠন-পাঠন, ইসলামি গল্প ও দোয়া শেখানোর পদ্ধতি আরও ফলপ্রসূ হতে পারে।

মক্তব শুধু একটি শিক্ষাকেন্দ্র নয়। এটি একটি মূল্যবোধের পাঠশালা। এখানে শিশুরা শেখে কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়, কীভাবে আল্লাহ-ভীরু হতে হয়, কীভাবে পরিবার, সমাজ ও দেশকে ভালোবাসতে হয়। মক্তব শিশুদের জীবনভিত্তির ওপর একটি সোনালি ছাপ ফেলে যায়, যা তাদের পুরো জীবনের পথনির্দেশনা হয়ে থাকে। আধুনিক যুগের প্রযুক্তি ও ভোগবাদী প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে, মক্তবকে সময়োপযোগী রূপে বিকশিত করে শিশুর চারিত্রিক গঠনে এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দিতে হবে। মক্তবকে ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে একটি নৈতিকতা-ভিত্তিক, সৎ ও আলোকিত প্রজন্ম।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

জনপ্রিয়