ঢাকা রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫ , ৬ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বিশ্ববিদ্যালয় কমিয়ে মান নিশ্চিত জরুরি

মতামত

মাছুম বিল্লাহ, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২০ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

বিশ্ববিদ্যালয় কমিয়ে মান নিশ্চিত জরুরি

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার ‘বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নিধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ বিষয়ক’ একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭০টি। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৫টি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত সরকারের আমলে। 

ইউজিসি তথ্য অনুসারে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে মোট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৭টি। এর মধ্যে ২৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে এই টাস্কফোর্স।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টাস্কফোর্সের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশমালা তৈরিতে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই নিম্ন মানসম্পন্ন।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের উদ্দেশেই এ একীভূতকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের সঙ্গে এবং কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। তবে একীভূতকরণের অর্থ এই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের ক্যম্পাস আগের জায়গায়ই থাকবে। তবে তারা একই নামে পরিচালিত হবে।

ড. ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকারই একীভূতকরণের উদ্যোগ নিতে পারে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষেত্রে একটি ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে পারে, যা তাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্জন করতে হবে। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ের মধ্যে মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের একীভূতকরণের পদেপেক্ষপ নিতে হবে।

টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য এবং বিডিজবস ডটকমের সিইও একেএম ফাহিম মাশরুর বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতি নেই। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারছি না। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী তা পরিপূর্ণ হচ্ছে না।

এ জায়গায় বিনিয়োগ তো অনেক হয়েছে। সরকারও অনেক বেশি পরিমাণে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে ফেলেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তো দরকার আছে বলে মনে হয় না। সংখ্যার বাইরে গিয়ে এখন গুণগত মানে ফোকাস করা দরকার। এক্ষেত্রে সংখ্যায় কমিয়ে হলেও গুণগত মান নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ দেড় দশকে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নিজস্ব ক্যাম্পাস, আবাসন ও ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। নিয়ম অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত বিবেচনায় প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন শিক্ষক থাকার কথা। 

কিন্তু দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত বজায় নেই ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে ১৮টি পাবলিক ও ৪৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়াও ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মানদণ্ড বজার রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি প্রোগ্রামে ন্যূনতম একজন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক থাকা বাধ্যতামূলক।

দেশের ১৩টি সরকারি ও ৬০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এমনকি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কোনো অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক ছাড়াই। দেশের সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বিষয়গুলো বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে একীভূত করার সুপারিশটি ইতিবাচক। এটি করা হলে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবসহ বিভিন্ন সংকট রয়েছে, তা দূর হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছয় বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩-এ উঠে এসেছে এ তথ্য যে দেশে উচ্চশিক্ষিত স্নাতক বা সান্তকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা ৯ লাখ ৬ হাজার। এর আগে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের শ্রমশক্তি জরিপে ৪ লাখ ৫ হাজার জন উচ্চশিক্ষিত বেকারের তথ্য উঠে এসেছিলো। সে হিসেবে ছয় বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ লাখ ৪ হাজার। মান নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, নতুন প্রযুক্তির উত্থান বা অটোমেশন এবং সবুজ ও টেকসই অর্থনীতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ফলে কাজে পরিবর্তন এসেছে। বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নতুন নতুন প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি শ্রম বাজারে আমুল পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নতুন প্রযুক্তি সার্বিক অর্থনীতি উন্নয়নে সাহায্য করবে কর্ম সংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আবার অনেক কর্মসংস্থান ধ্বংসও হয়ে যাবে। এই ফোরামের গবেষকরা বলছেন আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজার প্রায় এক চতুর্থাংশ বদলে যাবে।

কর্মমুখী শিক্ষা এমন এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা যা গ্রহণ করতে পারলে শিক্ষার্থীরা ঘরে-বাইরে, ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় যেকোনো পেশায় অতি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার যোগ্যতা লাভ করে। এই শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান মূলত পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো’ কর্মমুখী শিক্ষা নিলে, বিশ্বজুড়ে কর্ম মিলে।’

এই অবস্থার সঙ্গে আমরা যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রডাকশনের কথা চিন্তা করি বা তুলনা করি তাহলে দেখা যায়, এগুলোর অবদান দেশের চাহিদা ও বিশ্বের বাজারে নিতান্তই কম। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং যুগের চাহিদা অনুযায়ী জনস্পদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি করতে পারছে না।

তাই টাস্কফোর্স বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে জোর দিয়েছে। আর সব্যোপরি বলা যায়, সীমিত বাজেটের সঠিক ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থান নিশ্চিতে কিছু সরকারির সঙ্গে সরকারি এবং বেসরকারির সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একীভূতকরণের প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স। অতএব এটি একটি সময়োপযোগী প্রস্তাব।

 

জনপ্রিয়