
নতুন আশায় নতুন বছর শুরু হলো। বৈষম্যহীন শান্তির বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রামে জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে; শিক্ষা জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে। আমলা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ শিক্ষা জাতীয়করণের বিষয়ে নীতিগত সমর্থন ও সংহতি ব্যক্ত করেছেন।
এখন পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত বা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস খুব জরুরি। অন্যদিকে, তাদের বঞ্চনার অবসান যেন ‘কূঁজোর চিত হয়ে শোয়ার আকাঙ্ক্ষার সমার্থক! কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’র বিখ্যাত পঙ্কতিমালায় আছে:
‘...স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল...।
বর্তমানেও পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত বা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর অহংকার: ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার’। কিন্তু রূঢ় সত্য অর্জন-অতৃপ্তির ঘূর্ণাবর্তে শিক্ষা জাতীয়করণ এখন কল্পনাবিলাস মাত্র। শিক্ষা জাতীয়করণ চাওয়ার মূলত কয়েকটি কারণ হলো- ১. পেশাগত চরম বঞ্চনা। ২. একজন সাধারণ শিক্ষকের সামর্থ্য এখন এমন যে, কেউ আর তাদেরকে দৈনন্দিন ধার-কর্জও দিতে চায় না। ৩. খণ্ডিত জাতীয়করণের তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বাদ যাওয়া।
এমন আরো অনেক কারণে এমপিওভুক্তদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবুও মানুষ গড়ার নিপুণ-নীবর এসব কুশিলবদের আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয়নি। কারণ, যুগে যুগে কোনো দিনই মানুষের অধিকারের আওয়াজ হারিয়ে যায়নি।
জিজ্ঞাসা থাকতে পারে কেনো নিরিহ বেসরকারি শিক্ষকদের আহাজারি আকাশের অসীম শূন্যতায় মিলিয়ে যায়? তবে আত্ম-বিশ্লেষণে বলতেই হয়-সর্বস্তরের এমপিওভুক্তদের নেতৃত্বে ঐক্যের অভাব, সরকার ও শিক্ষক নেতৃবৃন্দের পারষ্পরিক যোগাযোগের অভাব, ঘোষিত কর্মসূচিতে সবার অংশগ্রহণ না থাকা, অতি আশাবাদী প্রবণতা, সঠিক নেতৃত্ব ও আন্তঃসাংগঠনিক সমন্বয়হীনতা এবং এ সবকিছুর পরও আমি আমার পেশাগত তিন দশকের বেশি অভিজ্ঞতায় সত্য বলতে কী।
পেশাগত দাবি আদায়ে আমাদের নেতৃত্বের অনৈক্য খুবই স্পষ্ট এবং আশ্চর্যজনক বাস্তবতায় এর কারণও যথার্থ। তা হলো-জাতীয় রাজনীতির ধারায় শিক্ষক সংগঠনগুলো দলীয় পরিচয়ে ও স্বার্থে ব্যবহৃত, শিক্ষক নেতারা ‘শিক্ষক পরিচিতি’র আড়ালে নিজেদেরকে নতুনভাবে মেলে ধরতে তৎপর এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোর পরষ্পর বিরোধী দারুণ অভিনব কর্মসূচি।
আকাশের লক্ষ তারার মতোই আমাদের শিক্ষক নেতাদের অসংখ্য ধারা! কাজেই, কেউ আমাদের ধার ধারেন না! আমাদের শিক্ষক সংগঠনের নেতারা হয়তো এ বিষয়ে একমত যে, ‘তারা কখনো ঐক্যবদ্ধ হবেন না’! কথাগুলো রূঢ় মনে হলেও, আমার পেশাগত অবস্থান বারবার বহুভাবে আমাকে এমনই তিক্ত বাস্তবতার নীরব সাক্ষী করেছে।
নানান বঞ্চনায় নিমজ্জিত এমপিওভুক্তদের আর কতোকাল আক্ষেপ ও অপেক্ষা করতে হবে? কে শোনাবে মানুষ গড়ার কারিগরদেরকে আশার বাণী?
বছরে অসংখ্যবার তেল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম বৃদ্ধিতে নিম্ন আয়/স্বল্প বেতনের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবনযাত্রায় সমন্বয় করা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। এমনকি ক্ষেত্রভেদে সন্তানের লেখাপড়া, ব্যক্তিগত চিকিৎসাসহ অনেক প্রয়োজনই রয়ে যায় অপূর্ণ। থমকে দাঁড়ায় জীবনের স্বাভাবিক গতি। সংসারের অভাব-অনটন ও অশান্তিতে জর্জরিত অনেকের গোপন কষ্টের হাহাকার তখন আর আড়াল থাকে না!
এক হিসেবে দেখা যায়-যদি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতনের পুরো অংশ সরকারি কোষাগারে জমা নিয়ে শিক্ষার পুরো দায়িত্ব সরকার নিতো তাহলে সরকারের লাভ বেশি হতো। এমনিতেই বেসরকারি শিক্ষকরা বর্তমানে বেতন স্কেলের শতভাগ, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও আছে বাড়িভাড়া আর সামান্য মেডিক্যাল ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা।
আমরা বেসরকারি শিক্ষকরা বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পর জাতীয়করণের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি। শিক্ষার্থীদের থেকে আদায়কৃত অর্থসহ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে শিক্ষার পুরো দায়িত্ব সরকার নিলে এটাই হবে জাতীয়করণের সহজসূত্র। জাতীয়করণ হলে শিক্ষকরাই লাভবান হবেন না, লাভবান হবেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরাও। তারা তাদের দোরগোড়ায় পছন্দের সরকারি স্কুল-কলেজ পাবেন, সঙ্গে তাদের আর্থিক সাশ্রয়ও হবে।
পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার তাকিয়ে আছেন প্রধান উপদেষ্টার দিকে। তিনি নিজেই শিক্ষক এবং শিক্ষক দরদি ব্যক্তিত্ব। তার সুস্পষ্ট ঘোষণা বাংলাদেশের প্রায় ১০০ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর মুখে হাসি ও বুকে সাহস জোগাবে। এজন্যই ব্যক্তিগত আস্থার অবস্থান থেকে আমি মনে করি:
পাঁচ লাখ এমপিওভুক্তের ঐক্য যদি রয়, শিক্ষা জাতীয়করণ হবে নিশ্চয়।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ