
প্রত্যেক মানুষ তার মনের ভাব ও অনুভূতি প্রকাশ করে কথার মাধ্যমে। কারও কথায় মধু থাকে, কারও কথায় বিষও থাকে! মিষ্টি কথায় পর হয় আপন। কটু কথায় আপন হয়ে যায় পর। কথার মধ্যে রয়েছে এক সম্মোহনী শক্তি। সুন্দর বাচনভঙ্গি, বোধগম্য শব্দ, স্পষ্ট উচ্চারণ, হাস্যোজ্জ্বল মুখ- এগুলো মানুষকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করে। ইসলামে কথাবার্তার ক্ষেত্রেও কিছু আদব ও সুন্নত নির্দেশ করেছে। সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে:
সালাম দিয়ে কথা শুরু ও শেষ করা : পরস্পরে কথার বলার অন্যতম আদব হলো সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করা। সালামের মাধ্যমে পরস্পরের জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করা হয়। কোনো মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে কথা বলার আগে সালাম দেওয়া নবীজি (সা.)-এর আদর্শ। সালামের উত্তর দেওয়া আবশ্যক। হাদিস শরিফে হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: ‘সালাম হবে কথার আগে।’ (তিরমিজি শরিফ: ২৬০৯) কথার শেষেও সালাম দেওয়া সুন্নত।
স্পষ্টভাবে কথা বলা : পরিষ্কার উচ্চারণে স্পষ্ট করে কথা বলা চাই। বাক্যের প্রতিটি শব্দ যেন শ্রোতা সহজে বুঝতে পারে। প্রয়োজনে কথার পুনরুক্তি করা। রাসুল (সা.) বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা তিনবার পর্যন্ত পযন্ত পুনরুক্তি করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো কথা বলতেন তখন তা তিনবার বলতেন, যাতে তা বুঝে নেওয়া যায়। আর যখন কোনো গোত্রের কাছে এসে সালাম করতেন তাদের প্রতি তিনবার সালাম করতেন।’ (বুখারি : ৯৫)
কথার মাঝখানে কথা না বলা : একই সঙ্গে দুজন কথা বলা অনুচিত। একজনের কথা বলার মাঝখানে অন্যজন কথা বলবে না। এটা করলে কেউ কারও কথা শুনবে না, বুঝবেও না। তাই উচিত হলো একজনের কথা শেষ হলে আরেকজন কথা বলবে। অনুরূপভাবে এক বিষয়ে কথা বলার মাঝখানে অন্য বিষয় উত্থাপন করবে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন রাসুল (সা.) একটি মজলিসে জনসম্মুখে কথা বলছিলেন। ইতোমধ্যে এক বেদুইন তার নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? আল্লাহর রাসুল (প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে) আলোচনায় রত থাকলেন। এতে কেউ কেউ বললেন, লোকটি যা বলেছে রাসুল (সা.) তা শুনেছেন, কিন্তু তার কথা পছন্দ করেননি। আর কেউ কেউ বললেন, বরং তিনি শুনতেই পাননি। আল্লাহর রাসুল (সা.) আলোচনা শেষ করে বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বলল, এই যে আমি, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, যখন কোনো অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (বুখারি: ৫৯)
কর্কশ কণ্ঠে কথা না বলা : কর্কশ কণ্ঠে কথা বলা অভদ্রতা। তা পরিহার করা উচিত। কর্কশ কণ্ঠে কথা বলার দ্বারা ব্যক্তিত্ব খর্ব হয়। হজরত লোকমান হাকিম তার সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে সেগুলো উল্লেখ করেছেন। তার একটি হলো, নরম ও মোলায়েম স্বরে কথা বলা। কর্কশ কণ্ঠ পরিহার করা। লোকমান হাকিম সন্তানকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সুরা লোকমান: ১৯)
বড়দের সামনে সাবধানতা অবলম্বন করা : ছোটরা যখন বড়দের সামনে কথা বলবে তখন বড়দের সম্মানের প্রতি লক্ষ রাখা। কোনো কথায় যেন কেউ কষ্ট না পায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। বড়দের মতের বিপরীত কথা বলা প্রয়োজন হলে আদব ও সম্মান বজায় রেখে দ্বিমত পোষণ করা।
তৃতীয়জনকে এড়িয়ে কথা না বলা : কোথাও তিনজন একত্রে থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে অপর দুজন কানাকানি কথা বলা উচিত নয়। অথবা দুজন এমন ইঙ্গিতে কথা বলাও উচিত নয়, যা তৃতীয়জন বুঝে না। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো স্থানে একত্রে তিনজন থাকবে তৃতীয়জনকে ছেড়ে যেন দুজন কানাকানি না করে, যতক্ষণ না লোকদের সঙ্গে মিশে যায়। তাহলে তা তাকে কষ্ট দেবে।’ (বুখারি : ৬২৯০)। তবে চারজন হলে দুজনে কানাকানি করা নিষিদ্ধ নয়।
কল্যাণের কথা বলা : ভালো কথা কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। মন্দ কথা অকল্যাণের পথ খুলে দেয়। আল্লাহ তায়ালা ভালো ও পবিত্র কথাকে এমন পবিত্র বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন যার শিকড় মজবুত এবং যার শাখা সুশোভিত বিস্তৃত ও আকাশে উত্থিত, যেই গাছ অহরহ ফল দান করে। এবং নোংড়া ও খারাপ কথাকে নোংড়া বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যাকে মাটির ওপর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং যার কোনো স্থিতি নেই।
আমরা যত কথা বলি সব কথাই লিপিবদ্ধ হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঙ্গে দুজন ফেরেশতা নিযুক্ত করে দিয়েছেন। তারা আমাদের আমলনামা লেখেন। ডান কাঁধের ফেরেশতা নেক আমলসমূহ লেখেন এবং বাম কাঁধের ফেরেশতা গুনাহসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা-ই গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সুরা ক্বাফ: ১৮)
মনে রাখতে হবে, কথা হলো একটি তীর। ধনুক থেকে তীর বের হলে যেমন তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না, কথাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। সুতরাং কথা বলায় সংযমী হওয়া এবং ভেবেচিন্তে কথা বলা কাম্য ও নিরাপদ।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ