
ঈমানদারের নিকট ঈমানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় থাকতে পারে না। ঈমান তার কাছে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়। যে ঈমান তার কাছে এতটা প্রিয়, এতটা মর্যাদার, সেই ঈমান যখন তার মতোই আরেকজন মানুষ ধারণ করে তখন তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠা অনিবার্য। এটা ঈমানের ভ্রাতৃত্ব। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব তো আরও কত কারণেই সৃষ্টি হতে পারে। একই দেশের নাগরিক, একই এলাকার বাসিন্দা, একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, একই কর্মক্ষেত্রে কর্মরত ইত্যাদি কত কারণেই তা গড়ে ওঠে! কিন্তু ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে অন্য কোনোটার তুলনা চলে না।
হিজরতের পর মদীনার আনসারগণ হিজরতকারী মুসলমানদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের যে নমুনা প্রদর্শন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ঘরবাড়ি ফেলে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শুধুই নিজেদের ঈমান রক্ষার তাগিদে মদীনায় যারা হিজরত করেছিলেন, তাদেরকে মদীনাবাসী নিজেদের ভাই বানিয়ে নিয়েছিল। ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধনকে তারা এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিল যে, মুহাজিরদেরকে তারা নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে, নিজেদের সম্পদে অংশীদার বানিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ নিজের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে কাউকে তালাক দিয়ে নতুন এই ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে চেয়েছে।
মুমিনদেরকে রাসুলুল্লাহ (সা.) তুলনা করেছেন একটি দেহের সঙ্গে। এক অঙ্গের অসুস্থতায় পুরো দেহ যেমন কাতর হয়ে পড়ে, তদ্রুপ পৃথিবীর এক অঞ্চলের মুসলমানের ব্যথা অন্য সব অঞ্চলের মুসলমানগণ অনুভব করতে হবে। তখনই এই ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা হবে। হাদিস শরিফের ভাষ্য- তুমি মুমিনদের দেখবে, তারা পারস্পরিক দয়া-মায়া ও স্নেহের বিষয়ে একটি দেহের মতো। দেহের এক অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয়, তখন পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। (বুখারি শরিফ: ৬০১১) অন্য হাদিসে হজরত সাহাল ইবনে সাদ আস সায়েদী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঈমানদারদের সঙ্গে একজন মুমিনের সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন সম্পর্ক দেহের সঙ্গে মাথার। ঈমানদারদের দুঃখ-কষ্ট ঠিক সেভাবেই সে অনুভব করে, যেমন মাথা দেহের ব্যথা অনুভব করে। (মুসনাদে আহমাদ: ২২৮৭৭)
এই হল ভ্রাতৃত্বের নমুনা। ভ্রাতৃত্বের এই দাবি মেটাতে গিয়ে মুমিন তার সবটুকু সাধ্য ব্যয় করবে। সময়ের চাহিদা বুঝে সে এগিয়ে আসবে। মুমিনের পাশে মুমিন থাকবে। কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো প্রয়োজন হলে শুধুই সঙ্গ দিয়ে সে তাকে সহযোগিতা করবে। বিপদের মুহূর্তে পাশে এসে সান্ত্বনার বাণী শোনালেও মানসিক শক্তি বেড়ে যায় অনেক।
সহযোগিতা বলতে আমরা বুঝি কেবলই বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) এর গণ্ডিকে আরও বিস্তৃত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক কিংবা মজলুম হোক। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! মজলুমকে তো আমরা সাহায্য করব। কিন্তু জালিমকে কীভাবে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তাকে তার জুলুম থেকে বাধা দেবে। (বুখারি শরিফ: ২৪৪৪)
যে কোনো প্রয়োজনে ও যে কোনো সংকটে ঈমানদারগণ আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে। নিজের প্রয়োজনে যেমন প্রার্থনা করে, তেমনি অন্যের প্রয়োজন পূরণের জন্যও দোয়া করে। এ দোয়া করাটাও ভ্রাতৃত্বের পরিচায়ক। ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় দোয়া করার পুরস্কার হাদিস শরিফে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করে, তার জন্য নিয়োজিত ফেরেশতা তখন ‘আমীন’ বলে এবং এও বলে, তোমার জন্যেও এ দোয়া কবুল হোক। (মুসলিম শরিফ: ২৭৩২)
এই হলো ভ্রাতৃত্বের পরিচয়। বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবে, সুখে-দুঃখে কাছে থাকবে, অন্যায় করলে কিংবা ভুল পথে চললে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনবে, তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।
শেষ কথা, যে ঈমানকে বুকে ধারণ করে আমরা নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে পরিচিত করছি, সেই ঈমানের দাবিকে পূর্ণ করতে হলে আমাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও সুসংহত করতে হবে। কোথাও বিপরীত কিছু দেখা গেলে তার সমাধান করে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে সচেষ্ট হতে হবে। শান্তির সমাজ পেতে চাইলে এই ভ্রাতৃত্বের বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক