ঢাকা বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫ , ৯ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

আল-বেরুনী হতে পারেন এ প্রজন্মের প্রেরণা

মতামত

মো. নজরুল ইসলাম, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

আল-বেরুনী হতে পারেন এ প্রজন্মের প্রেরণা

উৎসাহী, বিদ্যোৎসাহী, জ্ঞানপিপাসু এবং কৌতূহলী পাঠক মাত্রেই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভারততত্ত্ব’ এর লেখক আল-বেরুনীর সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত। ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থের লেখকের আসল নাম আবু রায়হান মুহম্মদ বিন আহমদ যিনি সবার কাছে আল-বেরুনী নামে খ্যাত। খোরাসানের এক ইরানি পরিবারে ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আল-বেরুনীর জন্ম। ফারসিতে ‘বেরুনী’ শব্দের অর্থ বহিরাগত। বিদ্যোৎসাহী পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সে সময়ে বোখারা এবং খোরাসানে জমে বহু পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীর সমাবেশ হয়েছিলো। আল-বেরুনীর পারিবারিক বা বাল্যজীবনের তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তার সমসাময়িকদের মধ্যে ছিলেন বোখারার প্রখ্যাত দার্শনিক ইবনে সিনা। তিনি বেরুনীর চেয়ে বয়সে সাত বছরের ছোট। তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমস্যাদি নিয়ে পত্রালাপ হতো বলে জানা যায়।

আল-বেরুনী তার নিজের গ্রন্থে তার দুইজন শিক্ষকের--আবু নসর মনসুর ও বাগদাদ সরখসি--নাম উল্লেখ করেছেন। ইয়াকুত রুমি নামে তার এক জীবনীকার আব্দুস সামাদ নামে তাঁর আরেকজন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করেছেন। আল-বেরুনী একবার বোখারায় সামানি সম্রাট মনসুরের দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সময় বা তার কিছু আগে ইবনে সিনার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ’আসারুল বাকিয়া’তে আল-বেরুনী ইবনে সিনার সঙ্গে তাঁর পত্রালাপের কথা উল্লেখ করে তাঁকে তরুণ পণ্ডিত বলে অভিহিত করেছেন।

বাল্য বয়স থেকেই প্রচণ্ড জ্ঞানপিপাসু ছিলেন আল-বেরুনী। পড়া, লেখা এবং ভ্রমণ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। খোরাসানে থাকা অবস্থায়ই তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ও পুস্তিকা রচনা করেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি খোরাসান ত্যাগ করে ভাগ্য অন্বেষণে বের হয়ে পড়েন। খোরাসান ত্যাগ করে তিনি বোখারায় সুলতান মনসুরের দরবারে কিছুদিন বাস করেন এবং সুলতানের সাহায্যও লাভ করেন। কিন্তু পরিবেশের প্রতিকূলতার কারণে তিনি সেখানেও স্থায়ী হতে পারেননি। বোখারা ত্যাগ করে তিনি কিছুকাল ইতস্তত ঘুরে বেড়ান এবং দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন উপায়ে তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে থাকেন। অবশেষে তিনি তাবারিস্তানের জিয়ারিদ রাজবংশের বিদ্যোৎসাহী সুলতান আবুল হাসান কাবুস বিন ওয়াশমগির শামসুল আলির দরবারে আশ্রয় লাভ করেন। এখানেই তিনি বিভিন্ন প্রাচীন জাতির ঐতিহাসিক ধারণা ও কাল নিরূপণের পদ্ধতির বিবরণসম্বলিত ‘আসারুল বাকিয়া’ নামক তাঁর সর্বপ্রথম পুর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করে সুলতান আবুল হাসান শামসুল আলিকে উৎসর্গ করেন। বেরুনীর বিদ্যাবত্তা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং সুমিষ্ট বাচনভঙ্গি ছিলো অন্যতম গুণ, যার জন্য তিনি সুলতান আবুল আব্বাসের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন এবং সুলতান আবুল আব্বাস তাঁকে কূটনৈতিক কর্মভার অর্পণ করেন। তাঁর এই কূটনৈতিক কাজের দরুন তাঁর জ্ঞানের খ্যাতি গজনির রাজদরবারে পৌঁছে গিয়েছিললো।

দুর্ভাগ্যবশত এই স্মরণীয় জ্ঞানসাধকের জীবন নিষ্কণ্টক ছিলো না। পদে পদে তাঁকে ভাগ্যের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং নানান চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে তবেই সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে হয়েছে। ১০১৬ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানে এক সামরিক বিদ্রোহে সুলতান আবুল আব্বাস নিহত হলে বেরুনীর ভাগ্যেও নেমে আসে দুর্ভাগ্যের চরম অমানিশা। পার্শ্ববর্তী রাজ্যে অশান্তি ও বিদ্রোহ দমন করার অজুহাতে পরের বছরই সুলতান মাহমুদ সৈন্যসহ খোরাসানে প্রবেশ করেন এবং ফেরার সময় ১০১৭ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানের বহু সৈন্য ও সামরিক-বেসামরিক গণ্যমান্য লোককে বন্দি করে গজনিতে নিয়ে আসেন। এই বন্দিদের মধ্যে ছিলেন আল-বেরুনী ,তাঁর ওস্তাদ আবু নসর এবং বৈজ্ঞানিক আবুল হুসেন বিন বাবা আল খাম্মার আল-বাগদাদি প্রমুখ বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা পণ্ডিত। এই বন্দি জীবনকেও আল-বেরুনী কাজে লাগিয়েছিলেন সাংঘাতিকভাবে। তাঁর গতিবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও তিনি বন্দি অবস্থাতেও ভারতের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের কয়েকটি শহরে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় ভাষা শিক্ষা, গ্রন্থাদি সংগ্রহ ও পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন নিজের তীক্ষ্ণ মেধা খাটিয়ে। বন্দি অবস্থায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা শিক্ষা করা ও ভিন্ন সংস্কৃতি-সভ্যতার সঙ্গে গভীরভাবে পরিচয় স্থাপন করা যে তাঁর জন্য খুব সহজ কাজ ছিলো না, তা তাঁর জবানি থেকেই স্পষ্ট অনুমান করা যায়: ‘হিন্দুদেরকে সম্যকভাবে বোঝা আমার পক্ষে খুব কষ্টকর হয়েছে, অন্য কারোর তো কথাই নেই, যদি না আল্লাহর অনুগ্রহ তাকে ইচ্ছেমত ভ্রমণের স্বাধীনতা না দেয়, সে স্বাধীনতা আমার অদৃষ্টে ছিলো না। কারণ, কোনো কাজই আমার ইচ্ছে ও সুবিধামত সম্পন্ন করার সুযোগ ও ক্ষমতা আমার ছিলো না। যে অবস্থায় থেকে বেরুনীকে ভারতীয় ভাষা ও দর্শন বিজ্ঞানের সাধনা করতে হয়েছে তাতে যেকোনো মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়াটাই স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু কঠিন সাধনায় একাগ্র সাধক আল-বেরুনী ছিলেন দৃঢ় চিত্তের অধিকারী, তাই সুলতান মাহমুদের তাঁর প্রতি মর্যাদা দানে কার্পণ্য ও অনীহা তাঁকে মনোবলহীন করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। সম্পূর্ণ তাঁর একক প্রচেষ্টায়, নিছক জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে তাঁকে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে নিয়ত লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থের মধ্যে মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে এক-আধটি মন্তব্য তিনি করেছেন যার থেকে তাঁর কষ্টের পরিমাণ কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। বিজ্ঞান ও শিল্পকলার কথা বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এসব বিদ্যার সাধনায় রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা একান্ত দরকার, কেনোনা জ্ঞানসাধকের মনকে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর দুশ্চিন্তা থেকে কেবল রাজারাই মুক্তি দিতে পারেন, তাঁদের মননশক্তিকে উজ্জীবিত করে জ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করতে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। বর্তমান যুগ কিন্তু তেমন নয়, বরঞ্চ তার বিপরীত। কাজেই বিজ্ঞানের কোনো নতুন শাখার বিকাশ বা গবেষণা হবে, তেমন সম্ভাবনা আমার এ যুগে আর নেই।’ তাঁর এ খেদোক্তিই সে সময়ের বাস্তব প্রেক্ষাপটের একটা সম্যক ধারণা দেয়। ভারততত্ত্ব পর্যালোচনায় দেখা যায়, সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর পরই তিনি ভারততত্ত্বের যেসব উপাদান এতোদিন সংগ্রহ করেছিলেন তা গ্রন্থাকারে সন্নিবেশ করতে আরম্ভ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতো জটিল ও বিচিত্র তত্ত্ব ও তথ্য, এতো নিখুঁত পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনাকে এতো অল্প সময়ে প্রাঞ্জল ভাষায় ও বৈজ্ঞানিকের মিতবাক্যে এমন বিরাট গ্রন্থ রচনা করা সত্যি এক বিস্ময়কর শক্তির পরিচায়ক, এ এক অসাধারণ কীর্তি। তাঁর শক্তিশালী লেখনীতে অঙ্কিত ভারততত্ত্বে উঠে এসেছে হিন্দু ধর্মের ঈশ্বরে বিশ্বাস, ভাব ও ইন্দ্রিয়জগত সম্পর্কে ধারণা, সৃষ্ট জীবসমূহের শ্রেণিবিন্যাস, বেদ পুরাণাদির ধর্মগ্রন্থগুলোর কথা, ভারতীয় পরিমাণ বিজ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রাদির নাম, ভারতের নদ-নদীর বিবরণ, মরু-পর্বতের কথা, ভারতীয় জ্যোতিষী মতে আকাশ ও পৃথিবীর আকার অর্থাৎ এ যেনো দ্বিতীয় মহাভারত। কী নেই এতে? তাঁর ভারততত্ত্বের পরিধিই বলে দেয় এই মহামানবের জ্ঞানের পরিধি কতো বিশাল!

আল-বেরুনী তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানের চর্চা করেছেন। তাঁর মৃত্যুকালের একটি ঘটনা প্রমাণ করে দেয় তিনি ঠিক কতো বড় মাপের একজন জ্ঞান তাপস ছিলেন। ইয়াকুত রুমি নামক ১২ শতকের একজন লেখক আল-বেরুনী মৃত্যুর সময়ের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর সমসাময়িক নৈয়ায়িক আবুল হাসানের মুখের বর্ণনায় এভাবে-‘ওস্তাদ আল-বেরুনী যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর, তখন আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। সে অবস্থাতেও তিনি আমাকে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—একদিন তুমি উত্তরাধিকার আইনে মাতামহীর সম্পর্কের শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় করার নিয়ম সম্পর্কে কী বলেছিলে? তাঁর অবস্থা দেখে আমি বললাম, এখন কি সে আলোচনা করার সময়? তিনি বললেন, বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়ে মর্ত্যজগত ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে বিষয়টির জ্ঞানলাভ করে যাওয়া কি তুমি শ্রেয় মনে কর না? অগত্যা আমি বিষয়টির পুনরায় ব্যাখ্যা করলাম। তিনি তা হাসিমুখে স্মরণ করে নিলেন এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মাথা নাড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। কারণ, ততক্ষণে তাঁর শরীরে শক্তি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে আমি তখনও পথেই ছিলাম। এমন সময় কান্নার রোল শোনা গেলো। বুঝলাম ওস্তাদ আল-বেরুনী আর নেই। এই নির্ভীক, স্পষ্টবাক, অনমনীয়, অমায়িক এবং সর্বজ্ঞানের মহাসাগরের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সবসময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মাথা নুয়ে যাবে।

লেখক: পরিচালক (প্রশাসন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

জনপ্রিয়