ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫ , ১১ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বিবিচিনি শাহী মসজিদ : স্মৃতির অতলে ঘুমিয়ে থাকা এক প্রাচীন স্থাপত্য

মতামত

মুহাম্মাদ হাসিবুল হাসান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

বিবিচিনি শাহী মসজিদ : স্মৃতির অতলে ঘুমিয়ে থাকা এক প্রাচীন স্থাপত্য

স্মৃতির অতলে ঘুমিয়ে থাকা এক প্রাচীন স্থাপত্য ও সময়ের শৈল্পিক মেধায় গড়া এক নিখুঁত অলংকার—বিবিচিনি শাহী মসজিদ। এ যেন বাংলার বুকে এক জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে ইট, পাথর, কারুকাজ আর আকাশের গম্ভীর নীরবতা মিশে তৈরি করেছে এক অতুলনীয় সৌন্দর্য। বরগুনার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি গ্রামে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং এক শাশ্বত ঐতিহ্যের নিদর্শন, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার আকাশে-বাতাসে এক সুরেলা ধ্বনি তুলছে।

প্রাচীন ইতিহাসের সুরভী

এই মসজিদ কেবল ইট-পাথরের সমষ্টি নয়, এটি এক সময়ের আভিজাত্যের প্রতিচ্ছবি, এক রাজকীয় অধ্যায়ের জীবন্ত সাক্ষ্য। একটি ছোট্ট টিলার চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, যা স্থানীয়ভাবে বিবিচিনি শাহী মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদটির চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে খেজুরসহ নানা জাতের বৃক্ষরাজি, যা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে।

প্রবীণদের মতে, হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.) পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আগমন করেন এবং ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিবিচিনিতে মসজিদটি নির্মাণ করেন। তাঁর দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইসাবিবির নামানুসারে গ্রামের নাম বিবিচিনি রাখা হয় এবং তাঁদের স্মরণেই মসজিদটির নামকরণ করা হয় বিবিচিনি শাহী মসজিদ।

মসজিদের পাশে রয়েছে তিনটি ব্যতিক্রমী কবর। সাধারণ কবরের তুলনায় এগুলোর দৈর্ঘ্য অনেক বেশি, প্রায় ১৫-১৬ হাত। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানে হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.) এবং তাঁর দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইসাবিবি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

বিবরণ অনুসারে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.) ইন্তেকাল করেন এবং মসজিদের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতি আজও এ মসজিদের প্রতিটি ইট-পাথরে জ্বলজ্বল করছে, যা ইতিহাসের এক অমূল্য সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

কত শত ভোরের আজান, কত সন্ধ্যার মোনাজাত এই মসজিদের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, কে জানে? হয়তো কোনো মাটির প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় কোনো সুফিসাধক একসময় এখানে বসে আল্লাহর ধ্যান করেছেন, কোনো দরবেশ হয়তো এই গম্বুজের ছায়ায় বসে চিরন্তন সত্যের সন্ধান করেছেন।

মোঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অনবদ্য গাঁথা

বিবিচিনি শাহী মসজিদ বাংলার মোগল ও সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর এক অনবদ্য নিদর্শন। এটি এমন এক সৌন্দর্য, যা কালের প্রলয়েও অমলিন রয়ে গেছে। তিনটি সুদৃশ্য গম্বুজ মাথায় তুলে দাঁড়িয়ে আছে, যেন আকাশের নীলিমায় মিশে এক সেতুবন্ধ রচনা করেছে। দেয়ালের মোটা গাঁথুনি, সুদৃশ্য খিলান, পাথরের অলংকরণ ও কারুকাজ—সবকিছুই এক অতুলনীয় শিল্পকর্মের মতো মনে হয়।

মসজিদের স্থাপত্যশৈলী এক অনন্য ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩৩ ফুট করে এবং দেয়ালের পুরুত্ব ৬ ফুট। নির্মাণে ব্যবহৃত ইটগুলোর মাপ মোঘল আমলের ইটের মতো। সমতল ভূমি থেকে ৩০ ফুট উঁচু টিলার ওপরে অবস্থিত মসজিদের মূল কাঠামো আরও ২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট, যা দূর থেকে দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপত্যরূপ ধারণ করেছে।

মেহরাব আর মিনারের সূক্ষ্ম নকশা, যেন কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা এক স্বপ্নলোক। এখানে প্রাচীন লিপির অলংকরণ, ফুল-লতাপাতার সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং পাথরের খোদাই করা নকশাগুলো এক অপূর্ব শিল্পভাস্কর্যের রূপ পেয়েছে। দিনের আলোয় এই মসজিদের দেয়ালে সূর্যের কিরণ পড়ে স্বর্ণালংকারের মতো ঝলমল করে ওঠে, আর রাতে চাঁদের আলোয় এর রূপ হয়ে ওঠে পরীর রাজ্যের মতো রহস্যময়।

সংস্কার ও সংরক্ষণ: সময়ের কাছে আমাদের ঋণ

যুগ বদলেছে, সভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু বিবিচিনি শাহী মসজিদ আজও অতীতের সৌন্দর্য ধরে রেখেছে। যদিও দীর্ঘ সময় অবহেলায় নিমজ্জিত ছিল, তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে এটি সংস্কার করা হয়। কিন্তু প্রকৃত সংরক্ষণ কেবল ইট-পাথরের মেরামত নয়, বরং ইতিহাসের প্রতি মনের গভীর ভালোবাসা থেকেই আসতে হবে। এই মসজিদ শুধু একখণ্ড স্থাপনা নয়, এটি বাংলার এক ঐতিহাসিক আত্মপরিচয়। এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি খিলান, প্রতিটি কারুকাজ বাংলার অতীতের গৌরবগাঁথার প্রতিচ্ছবি।

শতাব্দীর এক বিস্ময়

বিবিচিনি শাহী মসজিদকে শুধুই এক স্থাপত্য বলে ভাবা ভুল। এটি বাংলার মাটি, বাংলার মানুষ, বাংলার ইতিহাসের এক শাশ্বত কাব্য। এই মসজিদের আঙিনায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করে, তবে হয়তো অনুভব করতে পারবেন—এখানে বাতাসের প্রতিটি স্পন্দনে অতীতের ধ্বনি বাজে, যেন শত শত বছর আগের কোনো এক ফজরের আজান আজও মৃদু স্বরে প্রতিধ্বনিত হয়।

বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং এটি ইতিহাসের সুরেলা সংগীত, যা চিরকাল বাংলার আকাশে প্রতিধ্বনিত হবে।

লেখক: শিক্ষক ও অনুবাদক

জনপ্রিয়