
‘এআই’ সফটওয়্যারকে শেক্সপিয়ার কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো কবিতা লিখে দিতে কমাণ্ড দিলে চোখের পলকে এআই আমাদের সামনে হাজির করবে শেক্সপিয়ার কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো কবিতা!
কোনো শিক্ষার্থী গণিতের সমস্যা সমাধানের জন্য এআই-এর সাহায্য নিয়ে যদি নিমিষেই সমাধান করে ফেলে তাহলে কেমন হবে? শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীর ওপর এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে কিছুদিনের মধ্যে তার দুর্বল বা সবল দিক বের করে ফেললে বিষয়টা নিশ্চয় মন্দ হবে না।
এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পৃথিবীতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সমষ্টিজীবনে এআই-এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে সংশয় ও সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে এই প্রযুক্তি। সংশয়টা মূলত কর্মক্ষেত্রে চাকরি হারানোর। যুগে যুগে বিভিন্ন প্রযুক্তি পৃথিবীতে অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছে। সহজ করেছে মানুষের জীবনযাত্রাকে।
বিশাল আকৃতির কম্পিউটার ছোট হতে হতে এখন নোটবুকে রূপান্তর হয়ে মানুষের নিত্য ব্যবহারের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। বিশ্বগ্রামের ধারণায় প্রযুক্তির প্রভাব বিশ্বব্যাপী। উন্নত দেশসমূহে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, পরিবেশ, ব্যবসা, শিল্প, দুর্যোগ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ভূমি ব্যবস্থায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। সামগ্রিকভাবে মানুষের ইহজীবনের যাবতীয় ইচ্ছেপূরণের চাবিকাঠি হিসেবে আর্বিভূত করা হচ্ছে এআইকে! শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন এই প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহারের কথা শোনা যাচ্ছে।
কোনো শিক্ষার্থী বছর শেষে তার নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারলো কি না তা এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দূরশিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষা আরো সহজ হয়ে যাবে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে। অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টটেশন, কোডিং করা, মূল্যায়ন, চাকরির প্রস্তুতি এখন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ‘চ্যাটজিপিটি’ ব্যবহার করে শিক্ষক সহজে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি বা ক্লাসের প্রস্তুতি নিতে পারবে এআই-এর মাধ্যমে।
শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা শনাক্ত করতে, দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে এবং জটিল সমস্যা সমাধানে এই সফটওয়্যার ব্যাপকভাবে সহায়ক হতে পারে। এআই চালিত ভাষা সফটওয়্যার দিয়ে ডকুমেন্ট লেখা, ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধি, ভাষার সাবলীলতা বৃদ্ধিতে দারুণ কাজে আসবে। ইতিমধ্যে ভার্চ্যুয়াল স্টাডি অ্যাসিসট্যান্টগুলো শিক্ষার্থীর পরীক্ষার প্রস্তুতি ও শেখার কলাকৌশলে ভূমিকা রাখছে।
‘মাইস্টাডিলাইভ’ এমনই একটি সফটওয়্যার যেটি শিক্ষার্থীদের হোম টিউটরের মতো ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের কাজ পর্যবেক্ষণ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সিদ্ধহস্ত এআই সফটওয়্যার। সহজ কথায় শিক্ষাকে আরো কার্যকর করতে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য কমাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এআই প্রযুক্তি সমগ্র দুনিয়ায় দারুণ সব পদ্ধতি নিয়ে হাজির হয়েছে।
ভবিষ্যৎ চাকরির বাজার এআই নির্ভর হবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এআই ব্যবহার করে আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখছেন। ইততোমধ্যে গুগলের বিকল্প হিসেবে ‘চ্যাটবট’ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টটেশন-এর কাজসহ শিক্ষাগ্রহণের বিভিন্ন কাজে এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাপক সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে চীনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অতঃপর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে চীনের প্রায় পাঁচ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এআই নিয়ে স্নাতক প্রোগ্রাম চালু করা হয়। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে যুগে যুগে বিভিন্ন প্রযুক্তি বিপ্লব বয়ে এনেছে এবং আনছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন শিক্ষাক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সেখানে বাংলাদেশেরও বসে থাকার সুযোগ নেই।
এখন আমেরিকার এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরে ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। শিক্ষকরা যদি সঠিকভাবে জ্ঞান ও সৃজনশীলতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে অবধারিতভাবে এআই সম্পূর্ণভাবে তার জায়গা দখল নেবে। আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষাবিস্তারে এবং বৈষম্য কমাতে এআই-এর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে এআই শিক্ষা বিস্তারে দুইভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা-তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা এই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানবে এবং পরবর্তী ধাপে এর ব্যবহার শুরু করবে। অতঃপর শিক্ষাক্রমে এআইকে প্রাধান্য দিয়ে সে অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে জোর দিতে হবে।
তবে এটাও ঠিক, যতো বেশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তত বেশি সমস্যা-এমন একটা কথা প্রচলিত আছে! পৃথিবীতে প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের পরিক্রমায় ডিজিটাল প্রতারণাও বেড়েছে। তাই বলে তো আর প্রযুক্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা যায় না! এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় কথা শোনা যাচ্ছে।
একটা প্রযুক্তি শতভাগ খাঁটি হতে পারে না। ব্যবহারের ধরনের ওপর ভালোমন্দ নির্ভর করে। এআই আসলেই কী সব মানুষের জন্য হবে নাকি শুধু মুষ্টিমেয় উন্নত দেশের হাতে বন্দি থাকবে? পৃথিবীকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা যেমন প্রযুক্তির রয়েছে তেমনি খারাপভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও রয়েছে!
প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। এআই-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষককে প্রতারিত করা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অন্যের লেখা প্লেজারিজমের মাধ্যমে চালিয়ে দেয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, পক্ষপাত, ডিজিটাল প্রতারণা, অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিষয়টি এখন ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ প্রভাবিত করার ভয় তো রয়েছেই! সবচেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে। নৈতিকতার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে নজর দেয়া হচ্ছে।
তবে এআই এর অপব্যববহার ঠেকাতে প্রযুক্তির সহায়তাও নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অপব্যবহার রোধে এআই অ্যাকটিভিশনের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কোনো অসৎ কাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে কি না তা শনাক্তকরণে টার্নিটিন-এর মতো প্রযুক্তি সামনে চলে এসেছে।
যাহোক এআই আর ভবিষ্যৎ কল্পনা নয়, এখন বাস্তব হাতিয়ার। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তির প্রভাব সবচেয়ে বেশি বেগে পৌঁছে যায় সবখানে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দরকার এআই ব্যবহারের নীতিমালার দিকে নজর দেয়া ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইসিটিভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে নজর দিতে হবে। এআই নিয়ে এখনই না ভাবলে শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হবে।
লেখক: শিক্ষক