গত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে বরিশালের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিকের কোনো ক্লাসে ঘটে যাওয়া ছোট্ট একটি গল্প। পাঠদানকালে পৌরনীতির শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের ছাত্রদের ওপর ভীষণ রেগে যান। শিক্ষক মহাশয় এক দুষ্টু ছাত্রকে সমাজবিজ্ঞান বইয়ের ব্রিটিশ শাসনামল অংশ থেকে শব্দ করে পাঠ করতে বলেন, যেন ওই কক্ষের সবাই শুনতে পান। ব্রিটিশরা বাংলায় ‘দ্বৈত শাসন’ প্রচলন করেছিল পড়তে গিয়ে নার্ভাস ছাত্রটি ভুলক্রমে ‘দৈত্য’ বলে ফেলেন। এতে শিক্ষক মহাশয় হেসে ওঠেন। তাঁর রাগ পড়ে যায়। ছাত্রটিকে পড়া থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ‘তুমি ভুল করে একটা ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করে ফেলেছো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা দখল করার আট বছর পর এক অদ্ভূত শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করে যে বিপুল ক্ষমতা অর্জন করেছিল, তাকে কেবল রূপকথার অতিকায় দৈত্য-দানবের সঙ্গেই তুলনা চলে।
১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ খাজনা বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। আর নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এভাবে নজিরবিহীন দ্বৈত শাসন শুরু হয়। অর্থের যোগান এবং সামরিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নবাবের পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্বভাবতই ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ করার কোন সাধ বা সাধ্য সেই ক্ষমতাহীন দায়িত্বের বোঝা বহনকারি পুতুল নবাবের ছিলো না। সামরিক ক্ষমতা ও নবাবের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেয়ে যায় দায়িত্বহীন ক্ষমতা। সব ধরনের জবাবদিহিতার উর্দ্ধে থাকা কোম্পানি একদিকে রাজস্ব নীতি নির্ধারণ ও রাজস্ব আদায় করতো, অন্যদিকে ব্যবসা পরিচালনা করতো। তারা নিজস্ব ব্যবসা করমুক্ত করা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী স্থানীয় ও অন্যান্য বিদেশি ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি কর আরোপসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে দ্রুতই কোম্পানি এ অঞ্চলে একচ্ছত্র ক্ষমতা ও বাণিজ্যিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই অসীম ক্ষমতাকেই সেদিন সেই শিক্ষক ‘দৈত্যাকার’ ক্ষমতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
‘দ্বৈত’ শাসন ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুটি বিরোধপূর্ণ সত্ত্বা তৈরি হয়- এক. রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা এবং দুই. ব্যবসায়ী হিসেবে রাজস্ব নীতিমালার আওতায় ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করা। এই বিষয়টি আজকের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। এবার ‘ফ্ল্যাশ ব্যাক’ থেকে আড়াইশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে আসা যাক। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সিংহভাগ রাষ্ট্রায়ত্ব বা সরকারি। কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এবং সংশ্লিষ্ট আরও কিছু আইনের আওতায় ৪৮টি কোম্পানি ও সংস্থা দ্বারা জ্বালানি (প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ) খাতের ব্যবসা, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি বাদে বোর্ড বা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বা চেয়ারম্যানের পদের সবগুলোতে সচিব বা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার আমলারা রয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা পরিচালক পদগুলোতেও রয়েছেন সিনিয়র সহকারি সচিব থেকে সচিব পদমর্যাদার আমলারা। এসব বোর্ডে নামকাওয়াস্তে কিছু আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষক প্রতিনিধি স্বতন্ত্র সদস্য বা পরিচালক হিসেবে থাকলেও আমলারাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাগ্যনিয়ন্তা। দেশের জ্বালানি খাতে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সম্পদ আহরণ, উন্নয়ন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তরে আমলাদের উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেছে বলে মনে হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বা কোম্পানি বোর্ডে কোম্পানির মালিক বা মালিকের প্রতিনিধি হিসাবে যে আমলারা রয়েছেন, তাঁরাই আবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাজেট বরাদ্দসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে ১৯টি সংস্থা ও কোম্পানি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের প্রধানের পদসহ মোট ৭৭টি পদে রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলারা। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীনে ২৯টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের প্রধানের পদসহ মোট ১১৬টি পদেই আমলারা কাজ করছেন। তাদের অধিকাংশ, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আমলারা, একাধিক কোম্পানি ও সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা সদস্য হিসেবে রয়েছেন। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দেশের জ্বালানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অর্থ বরাদ্দ, তদারকি ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয় যেমন- অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইত্যাদি রয়েছে।
সরকারি কোম্পানি ও সংস্থার পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে আমলারা যে সিদ্ধান্ত নেন, তারাই আবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে সে সিদ্ধান্ত যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেন। আমলারা কোম্পানি বোর্ডে থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা সংস্থার বিভিন্ন চুক্তি ও চুক্তি ব্যবস্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম তদারকি করেন। আবার এরাই মন্ত্রণালয়ে বসে এসব কোম্পানি কার্যক্রম তদারকি করেন। এমন স্বার্থ সংঘাত নিয়েই বাংলাদেশের সরকারি খাতের জ্বালানি (বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি) ব্যবসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলছে। ফলাফল হিসেবে দেশের জ্বালানি খাতে ভারসাম্যপূর্ণ, উন্নত ও দক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও চূড়ান্তভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যার কুফল ভোগ করছে দেশের গোটা অর্থনীতি ও জনগণ।
আমলাদের স্বার্থ সংঘাতযুক্ত ভূমিকার একটি জায়গাটি হলো- ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বনাম এসব সিদ্ধান্ত যাচাই-বাছাই ও তদারকির কর্তৃত্ব। অপরটি হলো- নিজেরাই (মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে) নিজেদের (কোম্পানি বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে) জন্য পালনীয় নীতিমালা প্রণয়ন। এপ্রিল ২০১৭ সংশোধিত রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো মোটাদাগে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা ও কোম্পানি এবং সামগ্রিকভাবে সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকি, গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকি, সংশ্লিষ্ট খাতের সংস্থাগুলোর সঙ্গে অন্য সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা বা কোম্পানির খসড়া চুক্তি নিরীক্ষা ও চুক্তি ব্যবস্থাপনা তদারকি ইত্যাদি। কিন্তু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাঁদের ভূমিকা সরকারি রুলস অব বিজনেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তাঁদের একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের সকল সংস্থা ও কোম্পানির বোর্ডের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। ফলে জ্বালানি খাতে তাঁদের দ্বৈত কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ একই সাথে তাঁরা গোটা খাতের নীতি নির্ধারণ করছেন এবং ‘ব্যবসায়ী’ হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভূমিকা রাখছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান
এ ধরনের পরিস্থিতিতে জ্বালানি খাতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো অবধারিতভাবেই স্বার্থ সংঘাতযুক্ত ও ভারসাম্যহীন। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের বিশেষায়িত ও অভিজ্ঞতালব্ধ মতামত গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্তের গুণগত মান, প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা এবং সার্বিকভাবে দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তিন-চার বছরের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কিংবা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং পাওয়া আমলাদের ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তগুলোর জন্য তাঁদের জবাবদিহিতার আওতায় আনারও কোনো নজির মেলে না।
জ্বালানি খাতের জাতীয় পর্যায়ের নীতি নির্ধারণ ও প্রশাসনিক নজরদারির দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোই যখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেন, তখন দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হয়। এর নজিরও ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পরবর্তী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘দ্বৈত’ শাসন অভিজ্ঞতায় মেলে। ব্রিটিশদেরই দাবি অনুযায়ী, এ সময় কোম্পানির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ব্যবহার করে কোম্পানির কর্মচারিরা প্রজাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমাফিক রাজস্ব আদায় করেছে, কিন্তু সেই হারে কোম্পানির কোষাগারে অর্থ জমা দেয়নি। এসব কর্মচারি আদায়কৃত রাজস্বের অর্থ দিয়ে নামে-বেনামে ব্যক্তিগত ব্যবসা শুরু করেন এবং নানা ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ড যেমন- রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, সেতু নির্মাণ ইত্যাদি কাজের ঠিকাদারি কাজেও অংশ নেয়া শুরু করেন। ফলে বাংলায় এক চূড়ান্ত অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একদিকে ইতিহাসের ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি বাড়তে থাকে। এই আলোচনায় নবাবের ভূমিকাকে কোনো ধরনের তুলোনায় আনা হয়নি। বরং কোম্পানির সাথে সরকার ও কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে আমলাদের তুলনা করলে চলমান পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করা যাবে।
জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত গ্যাস আমদানি, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ও ব্যয়ে অস্বচ্ছতা, প্রাথমিক জ্বালানির মতো জরুরি প্রয়োজনীয় পণ্যে নানা নামের ট্যাক্স ও ডিউটি, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে অস্বচ্ছতা (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ অমান্য করাসহ), চাহিদা ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যয়ের ফলে জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত দেশের জ্বালানি খাত। এসব সমস্যায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন দেশের জনগণ। এতোদিন জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ এখন পর্যাপ্ত সরবরাহও পাচ্ছেন না। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কমলে কিছুটা স্বস্তি মিললেও সংকট অপরিবর্তিতই থাকবে। ক্রমাগত আমদানি নির্ভরতা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে এসেছে, মানুষ বেশি টাকা দিলেও পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ পাচ্ছে না। কারণ আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের মার্কিন ডলার রিজার্ভ দ্রুত হারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। যা খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। জ্বালানি খাতে গত এক যুগ বিপুল বিনিয়োগের পরেও দেশের জ্বালানি বাজারে যে চূড়ান্ত অরাজকতা চলছে তার পেছনে এ খাতে আমলাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কতটা দায়ী তা তদন্ত ও উচ্চতর গবেষণার দাবি রাখে। তবে গবেষণা কাজে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি বলে মনে হয়। আর তা হলো, বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের (এ ক্ষেত্রে জ্বালানি সম্পদ) উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ সমাজের কোন কোন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের হাতে থাকবে? তবে ভারসাম্যপূর্ণ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার ধারণা থেকে বলা যায়, দেশের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন ও বণ্টন ব্যবস্থাপনার নীতিমালা প্রণয়ন ও তদারকির কাজ যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর আমলাদের হাতে থাকে, তাহলে এ খাতের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব সমাজের ভিন্ন পেশার মানুষদের হাতে থাকাটাই যৌক্তিক। তাতে বাংলাদেশের সংবিধান যেভাবে জ্বালানি সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি, ২০২২’ এর প্রস্তাবনার শুরুর অংশটি উল্লেখ করছি- ‘সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভূমি ও সাগরের অন্তঃস্থ সব জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের মালিক প্রজাতন্ত্র এবং ৭ অনুচ্ছেদ মতে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। অর্থাৎ মালিকানার সূত্রে যেসব সম্পদের ওপর জনগণের অধিকার রয়েছে জ্বালানি সম্পদ তার মধ্যে অন্যতম। ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জ্বালানি উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বণ্টন প্রণালীর মালিক হবে জনগণ। সে উদ্দেশ্যে রাষ্টায়ত্ত্ব সরকারি খাতগুলো সৃষ্টি করা হবে এবং জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে উৎপাদিত জ্বালানি ও জ্বালানিজাত পণ্য রাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহ হবে এবং বিলি বণ্টনে ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সমতা নিশ্চিত করা হবে। ... সুতরাং জ্বালানি ও জ্বালানিজাত পণ্য এবং তার উৎপাদনযন্ত্র, ব্যবস্থাপনা এবং বিতরণ ও বণ্টনের মালিক জনগণ বিধায় জ্বালানি অনুসন্ধান এবং জ্বালানি ও জ্বালানিজাত পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ ও বণ্টন এবং এসবের উন্নয়ন জনগণের কর্তৃত্বে নিশ্চিত হলে সস্তায় ভোক্তার জ্বালানি প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে পারে এবং জ্বালানির ওপর সাধারণ ভোক্তার স্বত্ত্বাধিকার অর্জন সহজ হয়।’
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
এই প্রবন্ধে জ্বালানি খাত বলতে প্রাথমিক জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক জ্বালানি-এ দুই খাতকে যৌথভাবে বোঝানো হয়েছে। কেতাবি অর্থে তো বটেই, সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া সারা পৃথিবীতে বিদ্যুৎকেও জ্বালানি হিসেবেই বোঝানো হয়। তবে বিদ্যুৎ হলো সেকেন্ডারি এনার্জি বা জ্বালানি। অর্থাৎ, প্রাথমিক জ্বালানি কিছু কারিগরি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের মতো সেকেন্ডারি জ্বালানি উৎপাদন করে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়- এর নাম হতে পারতো জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। কারণ জ্বালানি শব্দের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক জ্বালানিকেও বোঝানো হয়। এর দুটি বিভাগের নাম হতে পারতো- বিদ্যুৎ বিভাগ এবং প্রাথমিক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। কিন্তু তা হয়নি। ওই মন্ত্রণালয়ে বিদ্যুৎকে জ্বালানি থেকে পৃথক করে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ বিভাগের নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু জ্বালানিকে প্রাথমিক জ্বালানি না বললে যে ওর মধ্যে বিদ্যুৎও চলে আসে, সে বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এই গুরুত্ব না পাওয়াতেই হয়তো বাংলাদেশের গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই এ খাতের নামের এই বিভ্রাটটি চলমান। ফলে নামের এই বিভ্রাট মেনে নিয়েই এই প্রবন্ধটি লিখতে হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক