ম্যাগমা মহাসাগরগুলো হলো পৃষ্ঠের ম্যাগমার বিশাল ক্ষেত্র যা একটি গ্রহের বা কিছু প্রাকৃতিক উপগ্রহের বৃদ্ধির সময়কালে বিদ্যমান থাকে যখন মহাকাশীয় দেহ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে গলিত হয়। প্রারম্ভিক সৌরজগতে ম্যাগমা মহাসাগরগুলো গ্রহগুলো গলে এবং গ্রহের প্রভাব দ্বারা গঠিত হয়েছিলো।
বিজ্ঞানীরা এবার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে খুঁজে পেলেন ম্যাগমার প্রাচীন মহাসাগর । তাদের পর্যবেক্ষণ, চাঁদের দক্ষিণ মেরু একসময় ঢাকা ছিলো তরল গলিত শিলার সমুদ্রে। বিভিন্ন অনুসন্ধান এমন এক তত্ত্বকে সমর্থন করে, যেখানে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে চাঁদের পৃষ্ঠে ম্যাগমা গঠিত হয়েছিলো বলে দাবি করা হয়। গত বছরের আগস্টে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে ভারতের চন্দ্রযান-৩। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর তথ্য অজানা থাকায় অবতরণের পর থেকেই চাঁদের রহস্যময় এলাকায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে চন্দ্রযানটি। এ মিশনের লক্ষ্য ছিলো মূলত চাঁদের এ বিচ্ছিন্ন ও রহস্যময় অঞ্চলটি খুঁজে দেখা, যেখানে এর আগে কোনও মহাকাশযান অবতরণ করেনি। এ অনুসন্ধানটি ‘লুনার ম্যাগমা ওশান’নামের এক তত্ত্বকে সমর্থন করে থাকে, যার মূল বিষয় হচ্ছে চাঁদ কীভাবে গঠিত হয়েছিলো, তা খতিয়ে দেখা।
বিবিসির তথ্য মতে জানা যায়, চাঁদের প্রাথমিক বিবর্তনের তত্ত্ব বেশ শক্তিশালী। ভারতের মিশনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো প্রোগ্রামের মাধ্যমে চাঁদের মধ্য অক্ষাংশে ম্যাগমা মহাসাগরের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো। চন্দ্রযান-৩ মিশনে থাকা রোভারযান ‘প্রজ্ঞান’ গত বছরের আগস্টে ১০ দিন ধরে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অনুসন্ধান করেছিলো।
বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে, সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে যখন চাঁদ গঠিত হয়, তখন এটি ঠাণ্ডা হতে শুরু করে ও ‘ফেরোয়ান অ্যানথোসাইট’ নামে পরিচিত একটি হালকা ধাঁচের খনিজ চন্দ্র পৃষ্ঠে ভেসে ওঠে। আর এই ‘ফেরোয়ান অ্যানথোসাইট’ বা গলিত শিলাই চাঁদের পৃষ্ঠ গঠন করেছিলো।
নতুন এ অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করা গবেষণা দলটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ফেরোয়ান অ্যানথোসাইটের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি।
ভারতের ‘চন্দ্রযান-৩’ মিশনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অ্যাপোলো প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে চাঁদের মধ্য-অক্ষাংশে ম্যাগমা মহাসাগরের অস্তিত্ব থাকার বড় প্রমাণ মিলেছিলো।এদিকে, ‘চন্দ্রযান-৩’মিশনের সময়ও মিশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ভাদাওয়ালে ও তার গবেষণা দল।
গত বছর ভারতের ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করার পর এর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো ‘প্রজ্ঞান’ নামের রোভারটি, যা ১০ দিন ধরে চাঁদের পৃষ্ঠের আশপাশ ঘুরে দেখেছে। সে সময় চাঁদের ৭০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য রোভারটিকে সার্বক্ষণিক নির্দেশ দিয়ে যেতেন অধ্যাপক ভাদাওয়ালে ও তার সহকর্মীরা। রোবটটি এমনভাবে তৈরি যাতে এটি -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। পাশাপাশি, চাঁদের অসম ও ধুলাযুক্ত পৃষ্ঠে চলাচলের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতাও ছিলো এতে।
‘আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার’ নামের এক যন্ত্র দিয়ে এটি সর্বমোট ২৩টি পরিমাপ নিয়েছে, যা মূলত বিভিন্ন পরমাণুকে সক্রিয় করে ও চাঁদের মাটিতে থাকা বিভিন্ন খনিজ থেকে শক্তি উৎপাদন সম্ভব কি না, সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছে। এছাড়া গবেষণা দলটি চাঁদের এ অঞ্চলে চারশ কোটি বছর আগে আছড়ে পড়া এক বিশাল উল্কাপিণ্ডের অস্তিত্বও খুঁজে পেয়েছে। এ দুর্ঘটনার কারণে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ‘আইটকেন’ নামের অববাহিকা বা বেসিন তৈরি হয়েছে, যা সৌরজগতের অন্যতম বৃহৎ গর্ত। আর এর আয়তন আনুমানিক আড়াই হাজার কিলোমিটার, যা প্রজ্ঞান রোভারের খোঁজ চালানো এলাকাটি থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিজ্ঞানীরা সেখানে ম্যাগনেশিয়াম শনাক্ত করেছেন, যা চাঁদের গভীর থেকে এসেছে বলে দাবি তাদের। আর এটি সম্ভবত প্রাকৃতিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে উঠে এসেছে।