বিখ্যাত ফরাসি অণুজীববিদ লুই পাস্তুর ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন। এই অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে গ্লোব্যাল অ্যালায়েন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোল নামক সমন্বয়কারী সংস্থা ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের মৃত্যুদিবসে ২৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘জলাতঙ্ক নির্মূলে প্রয়োজন সকল প্রতিবন্ধকতা নিরসন’।
সাধারণত কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানরসহ উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক রোগ হয়। জলাতঙ্ক রোগ জেনাস লাইসাভাইরাস অন্তর্ভুক্ত ১২টি স্বতন্ত্র প্রজাতির অন্যতম ভাইরাসজনিত ব্যাধি। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জুনোটিক প্রকৃতির এই রোগ মানুষ, প্রাণী উভয়ের মস্তিষ্ক-প্রদাহ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই রোগের ভয়াবহতা লক্ষণ দেখা দিলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
তবে, খরগোশ বা ইঁদুরের কামড়ে এ রোগ হতে দেখা যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত রিপোর্ট (২০১৮) মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৯৬ শতাংশ জলাতঙ্ক সংক্রমণের জন্য কুকুর দায়ী। নিধন, অপসারণ না করে কুকুরজনিত জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে গণটিকা প্রদান, অভিভাবকত্ব প্রসারণ, বন্ধ্যাকরণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
বাংলাদেশে সর্পদংশন প্রতিরোধে করণীয় ও বর্জনীয়বাংলাদেশে সর্পদংশন প্রতিরোধে করণীয় ও বর্জনীয়
জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষ জল (পানি) দেখলে ভয় পায়। রোগীর তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যায় কিন্তু হাতে ধরা পানির গ্লাস ভয়ে মুখের কাছে নিতে সাহস করে না। যদিও বা মুখের কাছে নেয়, কিন্তু গিলতে সাহস করে না। প্রশ্ন হচ্ছে এই আতঙ্ক কেনো ঘটে? কারণ, আক্রান্ত রোগী তরল গিলতে গেলেই, তার গলা ও শ্বাসনালীর মাংসপেশী সংকোচনে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমন্বয় না হওয়াতে ফুসফুসে পানি ঢুকে অনবরত কাশির উদ্রেক ঘটে। এই অসহ্য ব্যথা ও কাশি সৃষ্ট ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণেই পানি দেখলেই তার আতঙ্ক আতঙ্ক লাগে। তীব্র তৃষ্ণা সত্ত্বেও পানি দেখলে তখন ভয় পায় সে। তাই এ রোগের নাম জলাতঙ্ক।
২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বিশ্ব কুকুরজনিত জলাতঙ্কমুক্ত হবে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্ধারিত এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। গত এক যুগ পরিক্রমায় বাংলাদেশের জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কতটা কার্যকর, তা জানার জন্য প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত রোগীর ইমিউনাইজেশন রেকর্ড বুক এবং ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদানের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে টাইম সিরিজ গবেষণা চলছে।
‘দ্য ল্যানসেট রিজিয়নাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়া’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণামতে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার এলাকায় গড় কুকুর ঘনত্ব ১২.৮৩ এবং মোট কুকুরের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। মানুষ ও কুকুরের অনুপাত ৮৬.৭ অর্থাৎ প্রত্যেকটি কুকুরের বিপরীতে জনসংখ্যা প্রায় ৮৭ জন এবং ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান কার্যক্রমে দেশের প্রত্যেকটি জেলায় গড়ে প্রায় ২১,২৯৫টি কুকুর টিকাপ্রাপ্ত হয়। জিনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ দেশের জলাতঙ্ক ভাইরাস আর্কটিক ১ গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের জলাতঙ্ক ভাইরাসের মিল রয়েছে। দু’দেশের জলাতঙ্ক ভাইরাসের উৎপত্তি গ্রুপ এক, তবে স্ট্রেন স্বতন্ত্র। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সম্পন্ন এ গবেষণা সুস্পষ্ট করছে বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসে ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান এবং প্রাণীকামড়ে আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকর।
রাসেলস ভাইপার সাপে কাটলে যা করবেন, যা করবেন না রাসেলস ভাইপার সাপে কাটলে যা করবেন, যা করবেন না
সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ মতে দেশের অবহেলিত রোগগুলোর অন্যতম জলাতঙ্ক। এই আইনে শতভাগ মরণব্যাধি হওয়ার পরও জলাতঙ্ক আক্রান্ত মৃত ক্লিনিক্যাল রোগীর ময়নাতদন্ত করার বিধান সুস্পষ্ট করা হয়নি। অথচ দেশের বিদ্যমান সিস্টেমে বিষপান, আত্মহত্যা, হত্যাকাণ্ডের মতো অমানবিক ঘটনায় অহরহ ময়নাতদন্ত হয়। জলাতঙ্ক আক্রান্ত রোগীর ময়নাতদন্ত বলতে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ তে একটি উপযুক্ত ধারা/উপধারার সংযোজন করা। জলাতঙ্ক নির্মূল অগ্রযাত্রার (২০১১-২৪) সময়ে এখনো জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষে একটি কেসও ল্যাবরেটরি ডায়াগনোসিস হয়নি। তবে আশার কথা গত তিন বছরে জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষের লালা থেকে ৩টি কেস পজিটিভ শনাক্ত করা হয়েছে।
জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যু অনিবার্য হলেও এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান কুকুরে নিয়মিত জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান। জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেওয়া হয়, যদি কোন নির্দিষ্ট এলাকা/দেশের মোট কুকুরের ৭০ শতাংশকে টিকা দিলে, ওই এলাকা/দেশের সব কুকুরের শরীরে সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। ফলে জলাতঙ্ক ভাইরাস কুকুর থেকে কুকুরে কিংবা মানুষে সংক্রামিত হতে পারে না। অর্থাৎ ব্যাপকহারে টিকাদান নিশ্চিত করলে মানুষ ও কুকুর উভয়ই নিরাপদ থাকবে।
সাপ: খারাপ প্রাণী নয়, কিন্তু খারাপভাবে উপস্থাপিতসাপ: খারাপ প্রাণী নয়, কিন্তু খারাপভাবে উপস্থাপিত
প্রাথমিক লক্ষণ দেখে কুকুরে জলাতঙ্ক সংক্রমিত হয়েছে কিনা বুঝতে পারা অনেক কঠিন। কুকুরের কামড়ে আতঙ্কিত না হওয়া কিংবা ঐ কুকুরের কোন ক্ষতি করা যাবে না। কুকুর/প্রাণী দ্বারা কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ক্ষতস্থানটি অবশ্যই সাবান পানি দিয়ে ১৫ মিনিট ধরে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ভীতি দূর করে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। আক্রমণকারী কুকুর কিংবা প্রাণীটাকে নিধন কাম্য নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই রেজিস্টার্ড প্রাণী ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকে জলাতঙ্ক রোগের প্রকোপ থেকে সুরক্ষা একমাত্র টিকাই দিতে পারে। ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বার্থে পোষা কুকুর বিড়ালসহ এলাকার সকল কুকুরে টিকা নিশ্চিত করতে হবে। ভয় নয়- ইতিবাচক সহযোগিতা, টিকায় সম্ভব জলাতঙ্ক মুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ।