মোগল সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মুঘল বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময়টাকে ঢাকা নগরীর জন্ম বছর ধরে নিয়ে মহাধুমধামে দুইবছরব্যাপী ‘ঢাকার ৪০০ বছর’ উৎযাপন শুরু করে এশিয়াটিক সোসাইটি। যদিও মূর্তি ও লিপিতাত্ত্বিক প্রমাণের আলোকে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি বলে আসছিলো, ঢাকার বয়স হাজার থেকে ১২শ বছর হবে। কিন্তু, তাতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনদের নেতৃত্বে ‘৪০০ বছর’ উৎসবে ভাটা পড়েনি। তবে এবার বলা হচ্ছে, আড়াই হাজার বছর আগেও মানববসতি ছিলো ঢাকায়।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে পরিচালিত প্রত্নতত্ত্বিক খনন শুরুর পর বলা হচ্ছে, সেখানে বিশাল প্রাসাদ দুর্গের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এটি প্রমাণ করছে যে, জনপদ হিসেবে ঢাকার বয়স আড়াই হাজার বছরেরও বেশি।
ঢাকা শহর কেবল চারবার নয়, সাতবার রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছে। সময় বিভাগ অনুসারে, আদি ঐতিহাসিক যুগ (খ্রি.পূ ষষ্ঠ শতক), প্রাক্-মধ্যযুগ (ষষ্ঠ থেকে ত্রয়োদশ শতক), সুলতানি আমল (ত্রয়োদশ-ষোড়শ শতক), মোগল আমল (ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক), ঔপনিবেশিক আমল (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ), পাকিস্তান যুগ (১৯৪৭-১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী (১৯৭১ থেকে বর্তমান)।
গত মঙ্গলবার বিকেলে এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘পুরাতন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন: ঢাকার গোড়াপত্তনের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক আলোচনায় খননে প্রাপ্ত নিদর্শন প্রদর্শন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও খননকাজের তত্ত্বাবধায়ক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। এশিয়াটিক সোসাইটি তাদের ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’-এর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই আলোচনা আয়োজন করে।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তার নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও শিক্ষার্থী ২০১৭-১৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ করেন। তারা কারাগারের প্রধান ফটকের সামনের অংশ, রজনীগন্ধা ভবনের আঙিনা, কারা হাসপাতালের সামনের অংশ, দশ সেল ও যমুনা ভবনের পশ্চিম এলাকা-এই পাঁচ স্থানে ১১টি খননকাজ করেন। এতে তারা একটি প্রাচীন দুর্গের দেয়াল, কক্ষ, নর্দমা, কূপের সন্ধান পান। এ ছাড়া এখানে কড়ি, মোগল আমলের ধাতব মুদ্রা, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ভাস্কর্যসহ অনেক রকম প্রত্ননিদর্শন পেয়েছেন।
পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় এসব নিদর্শনের ছবি এবং তথ্যের বিশ্লেষণসহ আলোচনায় সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয়েছে, ইসলাম খানের আগমনের অনেক আগেই ঢাকায় একটি প্রাসাদ দুর্গ ছিল। সুবাদার ইসলাম খানের সেনাপতি ও লেখক মির্জা নাথান তার ‘বাহারীস্তান-ই-গায়েবী’ বইতে ঢাকায় যে দুর্গের কথাটি উল্লেখ করেছিলেন, সেটিকে পরে ইতিহাসবিদেরা ‘ঢাকাদুর্গ’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। এই দুর্গে ইসলাম খান বসবাস করেছেন। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে পাওয়া নিদর্শন যুক্তরাষ্ট্রের বেটা ল্যাবরেটরিতে কার্বন-১৪ পরীক্ষা করার পর প্রমাণ পাওয়া গেছে, এগুলো ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের। ফলে এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যাচ্ছে, এই দুর্গ ইসলাম খানের আসার আগেই নির্মিত হয়েছিল এবং এটিকে ‘ঢাকাদুর্গ’ নয়; বরং ‘ঢাকার দুর্গ’ বলা সংগত।
অধ্যাপক সুফি বলেন, ইসলাম খানের আগে ঢাকার ইতিহাস স্পষ্ট নয়। নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদসহ কিছু নিদর্শন থেকে এটা জানা গিয়েছিল, ইসলাম খানের আগমনের আগেও এখানে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। কিন্তু এই খননের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, শুধু জনপদই নয়, এখানে অন্তত বড় একটি প্রাসাদ দুর্গ ছিল এবং সমৃদ্ধ নগর ছিল। যেখানে সুবেদার ও তার সঙ্গে আসা ৫০ হাজার সেনার বিশাল বাহিনী বসবাস করেছিলেন।
এ ছাড়া আরও তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হলো, কয়েকটি ‘গ্লেজড মৃৎপাত্র’ (অনেকটা সিরামিকের মতো চকচকে) এবং ‘রোলেটেড মৃৎপাত্র’ (মসৃণ ও সূক্ষ্ম নকশা করা), যা থেকে অনুমান করা যাচ্ছে, ঢাকায় অন্তত পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জনবসতি ছিল। কারণ, একই ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন (মহাস্থান) ও উয়ারী বটেশ্বরে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়ায়। এই মৃৎপাত্র পাওয়ায় প্রমাণিত হচ্ছে, এখানে একটি আদি ঐতিহাসিক যুগে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। প্রাচীন সিল্ক রুটের সঙ্গে এই জনপদের সংযোগ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সূত্রে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল এবং এর বয়স আনুমানিক আড়াই হাজার বছর।
আলোচনার উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘রোজেটা স্টোন লিপি’ যেমন প্রাচীন মিসরে রহস্য উন্মোচন করেছিল, তেমনি পুরোনো ঢাকার কারাগারে খননে প্রাপ্ত নিদর্শন ঢাকাকে নতুন করে আবিষ্কারের দ্বার উন্মোচন করেছে। যে আলোকরশ্মির দেখা পাওয়া গেল, তা আরও বিস্তারিত গবেষণার মাধ্যমে এই জনপদের ইতিহাসকে নতুনভাবে আলোকোজ্জ্বল করবে।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণায় সহযোগী ছিলেন মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, মো. মামুন দেওয়ান, মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন, মো. আওলাদ হোসেন ও চাঁদ সুলতানা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পকলার ইতিহাসবিদ প্রবীণ অধ্যাপক হাবিবা খাতুন বলেন, ‘নতুন এই প্রত্নতাত্ত্বিক খননে যে নিদর্শন আবিষ্কৃত হলো, তা নতুন প্রজন্মকে ঢাকা সম্পর্কে আরও কৌতূহলী করে তুলবে। আমরা ঢাকার মোগল আমলের ঐতিহ্য নিয়েই এত কাল গর্ববোধ করতাম। কিন্তু এই শহরের ইতিহাস যে আরও সুপ্রাচীন, এখন তাতে আর কোনো সন্দেহ রইল না। গর্বের আরও নতুন ইতিহাস আমাদের সামনে এসেছে।’ এ বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্য সোসাইটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক হাফিজা খাতুন বলেন, ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস জানতে এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান।