উপমহাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউরি মহকুমার খয়রাডিহি গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সামি আহমেদ, মা বেগম আলিয়া। ৪ বছর বয়সে তিনি তার মাকে হারান। নানির স্নেহে তার শৈশবের দিনগুলো অতিবাহিত হয়।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সূচনা ঘটলে বহুরূপী নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন গানের স্কোয়াডে যোগদান করেন এবং পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কৃষ্ণনাথ কলেজ এবং ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ক্যাপিটাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু গণনাট্য সংঘের হয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে তার ডাক্তারি পড়ার অবসান ঘটে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন।
এসময় তিনি উত্তর কলকাতার প্রগতিশীল সংস্কৃতি ধারার নেতা সুধি প্রধানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। এবছর তিনি কলকাতায় মুসলিম প্রধান অঞ্চলে দাঙ্গার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এসময়ই এইচএমভি থেকে বের হয় তার গণসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড। সুবিনয় রায় ও শৈলজারঞ্জনের কাছে সংগীত বিষয়ে দীক্ষা নিয়ে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শুভ গুহঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত সংগীত বিদ্যালয় ‘দক্ষিণী’তে যোগদান করেন।
৪৬-এর দাঙ্গার প্রথমে তিনি গণসংগীত গাইলেও পরে রবীন্দ্রসংগীত-চর্চার দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং পরে মুক্তি পান। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন গণনাট্য সংঘের বিশৃঙ্খল অবস্থা, তখন কলিম শরাফী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মো. ইসমাইল প্রমুখের সঙ্গে মিলে ‘বহুরূপী’ নাট্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত নাট্য সংস্থাটি নবান্ন, পথিক, ছেড়াতার, রক্তকরবী, ইত্যাদি নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে।
কলিম শরাফী দুর্ভিক্ষের সময় (পঞ্চাশের মন্বন্তর) নঙ্গরখানায় কাজ করতে গিয়ে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফফর আহমদের সংস্পর্শে এসে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এসময় তিনি আর্থিক দুরাবস্থায় দিনাতিপাত করেন। ফলে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী আব্দুল আহাদ ও কবি সিকান্দার আবু জাফরের আহ্বানে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকায় এসে বেতারে যোগদান করেন। ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণসংগীত বিশেষত সুকান্তের ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি গেয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরে পড়েন। ফলে তিনি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে গিয়ে বসবাস করেন এবং সেখানে গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নাট্যদল। এ কাজে তার সঙ্গী ছিলেন একুশের কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, অচিন্ত্য চক্রবর্তী, এমএ সামাদ, রমেন মজুমদার, ফওজিয়া সামাদ, নিত্যগোপাল দত্ত প্রমুখ।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ‘জিইটি জেড ব্রাদার্স’ নামে একটি আমেরিকান কোম্পানিতে যোগদান করেন। একই বছর তিনি একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে কিছু সময় কাজ করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার কার্জন হলের সাহিত্য সম্মেলনে ‘প্রান্তিক’ দল নাটক ও নৃত্যসংগীত পরিবেশন করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ৯২-ক ধারা জারির ফলে শেরে বাংলার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা হলে তিনি আবার পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন এবং আত্মগোপনে বাধ্য হন। এবছরই তিনি ড. আনিছুর রহমান ও ড. রফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে হ-য-ব-র-ল সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ নাটকটি মঞ্চায়ন করেন।
তার প্রথম পেব্যাক হয় ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলায় নির্মিত আকাশ আর মাটি ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। ১৯৫৮-১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রেডিওতে নিষিদ্ধ ছিল তার গান। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এসএস মাসুদ প্রযোজিত সোনার কাজল ছবি পরিচালনা করেন। এসময় তিনি প্রামাণ্যচিত্র ভেনিস নির্মাণ করেন, চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জাপানি কারিগরি সহায়তায় পাকিস্তানে এনইসি নামে টেলিভিশন চালু হলে তিনি উক্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কলিম শরাফীর বিরুদ্ধে আবারো পাকিস্তানী চক্রান্ত চলতে থাকে।
তার পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করে জাপানে একটি প্রশিক্ষণে যাওয়া থেকে তাকে বিরত রাখা হয়। পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রোগ্রাম ডিরেক্টরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবছর তিনি উদীচীর সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের ব্রিটিশ কোম্পানি পরিচালিত রেকর্ডিং স্টুডিওতে ম্যানেজার ইস্ট পাকিস্তান হিসেবে যোগদান করেন। পরে জেনারেল ম্যানেজার, ডিরেক্টর ও জেনারেল ম্যানেজার ইস্ট পাকিস্তান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় একুশে উদযাপন উপলক্ষে গঠিত কমিটিতে কলিম শরাফীর নাম তালিকাভূক্ত করা হয়।
পরে উক্ত তালিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাকে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। কলিম শরাফী ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’(১৯৭৯, পরে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’)-এর প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক ছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘সংগীত ভবন’ নামে একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত ‘সংগীত ভবন’ এবং বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার তিনি সভাপতি ছিলেন। নববইয়ের দশকে কলিম শরাফী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণআদালতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় এবং ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ ঘাতক-দালাল বিরোধী গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করায় দেশের ২৪ বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে তাকেও মামলার আসামি করা হয়।
কলিম শরাফীর সঙ্গীত জীবন দীর্ঘ হলেও তার প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা মাত্র ১৮টি; ১৫টি ক্যাসেট, ৩টি সিডি। সংগীতাঙ্গনে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলিম শরাফী একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণপদক, শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র থেকে কৃতী বাঙালি সম্মাননা পদক, বাংলা একাডেমি কর্তৃক রবীন্দ্র পদকে ভূষিত হন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।