প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রসমালোচক ও শিল্পানুরাগী বিষ্ণু দের আজ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই কলকাতার পটলডাঙ্গায় তার জন্ম। পিতা অবিনাশচন্দ্র দে ছিলেন অ্যাটর্নি। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট ও সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে বিষ্ণু দে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ, সেন্ট পলস কলেজ থেকে ইংরেজিতে বিএ অনার্স এবং থেকে ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজে যোগদান করেন। পরে মৌলানা আজাদ কলেজ ও কৃষ্ণনগর কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের ফলে যে নতুন সাহিত্য উদ্যম ও ব্যতিক্রমী শিল্প চেতনার সৃষ্টি হয়, বিষ্ণু দে ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। কিন্তু ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কল্লোল পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৪৭ পর্যন্ত এর সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় সাহিত্যপত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিজেও ‘নিরুক্ত’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বিষ্ণু দে কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে তার সাহিত্য জীবন শুরু করেন। শুধু সাহিত্য বিষয় নয়, শিল্প, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির বিবিধ বিষয় নিয়ে তার বুদ্ধিদীপ্ত রচনা অভিনন্দিত হয়েছে। গদ্য ও পদ্যে তার বহু সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ: উর্বশী ও আর্টেমিস, চোরাবালি, সাত ভাই চম্পা, রুচি ও প্রগতি, সাহিত্যের ভবিষ্যৎ, নাম রেখেছি কোমল গান্ধার, তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত, রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা, মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা, In the Sun and the Rain, উত্তরে থাকো মৌন, সেকাল থেকে একাল, আমার হৃদয়ে বাঁচো ইত্যাদি। বিষ্ণু দে ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নব্যধারার আন্দোলনের প্রধান পাঁচজন কবির অন্যতম ছিলেন। তিনি মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কাব্যভাবনা ও প্রকাশরীতিতে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতাকে অঙ্গীকার করেই তিনি কবিতা লেখেন। তার কবিতায় টি.এস এলিয়টের কবিতার প্রভাব রয়েছে। দেশের অতীত ও বর্তমানের নানা বিষয় এবং বিদেশের বিশেষত ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যের বিচিত্র প্রসঙ্গ তার কাব্যের শরীর ও চিত্রকল্প নির্মাণ করেছে। এসব কারণে তার কাব্য দুর্বোধ্যতার অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়।
খ্যাতনামা কবি বিষ্ণু দে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সতীর্থ এবং চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধু। যামিনী রায়ের অনুপ্রেরণায়ই তিনি শিল্প-সমালোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বিষ্ণু দে’কে কবি-সম্বর্ধনা দেয়া হয়। তিনি ‘রুশতী পঞ্চশতী’র জন্য ‘সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার’ পেয়েছেন। ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো। সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
তিরিশের কাব্যধারায় বিষ্ণুদের মধ্যেই প্রথম রাবীন্দ্রিক কাব্যবলয় অতিক্রমণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মার্কসীয় তত্ত্বকে জীবনাবেগ ও শিল্পসম্মত করে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তার সাফল্য অপরিসীম। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।