বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছরব্যাপী বিস্তৃত।
সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক এবং ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে সবার বড়।
সৈয়দ হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সৈয়দ শামসুল হকের পিতার ইচ্ছা ছিলো তাকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। পিতার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছর খানেকের বেশি সময় এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস দেয়ালের দেশ প্রকাশিত হয়।
সৈয়দ হক তার বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়লে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে তোমার আমার, শীত বিকেল, কাঁচ কাটা হীরে, ক খ গ ঘ ঙ, বড় ভালো লোক ছিলো, পুরস্কারসহ আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। বড় ভালো লোক ছিলো ও পুরস্কার নামে দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকরি নেন। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
সৈয়দ হক প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হককে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী তার রচিত প্রথম পদ তিনি লিখেছিলেন এগারো-বারো বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তার বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দু’লাইনের একটি পদ ‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে’ রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেখানে ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়।
সৈয়দ হকের কবিতায় রয়েছে গভীর অনুপ্রেরণা। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। পরে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কোরাস, বৃষ্টি ও জলের কবিতা কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে পাঠকমহলে জনপ্রিয় করে তুলে। সৈয়দ হক মৃত্যুর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে তার শেষ কবিতা লিখেন। কবিতার নাম আহা, আজ কি আনন্দ অপার!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপন্যাস দেয়ালের দেশ প্রকাশিত হয়। তার রচিত এক মহিলার ছবি, অনুপম দিন, সীমানা ছাড়িয়ে উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষাটের দশকে তার রচিত উপন্যাসগুলো পূর্বাণী পত্রিকায় ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হত। তার রচিত ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসকে অনেকে যৌন আশ্রিত বলে আখ্যা দেন। তিনি উপন্যাসের ভূমিকায় এই উপন্যাসকে ‘এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সৈয়দ হক নাট্যকার হিসেবে সফলতা পেয়েছেন। বিবিসি বাংলায় নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তিনি নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান। তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্য নাটক। তার পরের নাটক নুরুলদীনের সারাজীবন ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। সৈয়দ হক তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ এবং মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেন। তার অন্যান্য নাটক নারীগণ, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা, ঈর্ষা, এখানে এখন-এ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেয়। চার মাস চিকিৎসার পর ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।