প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শওকত ওসমানের আজ জন্মদিন। তিনি ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান; ‘শওকত ওসমান’ তার সাহিত্যিক নাম।
শওকত ওসমান কলকাতার আলীয়া মাদরাসা থেকে প্রবেশিকা, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আইএ ও বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। আইএ পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন।
এমএ পাস করার পর তিনি গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্স-এ যোগ দেন এবং ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে স্বল্পসময় তিনি কৃষক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।
উপন্যাস ও গল্প রচয়িতা হিসেবেই শওকত ওসমানের মুখ্য পরিচয়; তবে প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, স্মৃতিকথা ও শিশুতোষ গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। বিদেশি ভাষার অনেক উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো: উপন্যাস জননী, ক্রীতদাসের হাসি, সমাগম, চৌরসন্ধি, রাজা উপাখ্যান, জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য, পতঙ্গ পিঞ্জর, আর্তনাদ, রাজপুরুষ; গল্পগ্রন্থ জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প, মনিব ও তাহার কুকুর, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী; প্রবন্ধগ্রন্থ ভাব ভাষা ভাবনা, সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই, মুসলিম মানসের রূপান্তর; নাটক আমলার মামলা, পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা; শিশুতোষ গ্রন্থ ওটেন সাহেবের বাংলো, মস্কুইটোফোন, ক্ষুদে সোশালিস্ট, পঞ্চসঙ্গী; রম্যরচনা নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত ইত্যাদি।
তার জননী ও ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাস দুটি প্রশংসিত হয়েছে। জননীতে সামাজিক জীবন ও ক্রীতদাসের হাসিতে রাজনৈতিক জীবনের কিছু অন্ধকার দিক উন্মোচিত হয়েছে। প্রাচীন কাহিনী, ঘটনা ও চরিত্রের রূপকে লেখক সমকালীন রাজনীতিতে স্বৈরাচারী চরিত্র ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। জননীতে গ্রাম ও নগরজীবনের সংঘাতে একটি পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার বিবরণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত নেকড়ে অরণ্য গ্রন্থে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলার নরনারীর নির্যাতনের করুণ বিবরণ আছে।
শওকত ওসমানের স্মৃতিকথামূলক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: স্বজন সংগ্রাম, কালরাত্রি খন্ডচিত্র, অনেক কথন, গুড বাই জাস্টিস মাসুদ, মুজিবনগর, অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ, সোদরের খোঁজে স্বদেশের সন্ধানে, মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা, আর এক ধারাভাষ্য ইত্যাদি। স্বজন সংগ্রামে তার ব্যক্তিগত জীবন-সংগ্রামের অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য অনূদিত গ্রন্থ: নিশো, লুকনিতশি, বাগদাদের কবি, টাইম মেশিন, পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়), স্পেনের ছোটগল্প, পাঁচটি নাটক (মলিয়ার), ডাক্তার আব্দুল্লাহর কারখানা, পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ, সন্তানের স্বীকারোক্তি ইত্যাদি।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, একুশে পদক, মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার -এ ভূষিত হন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে এই কথাসাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন।