প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের প্রয়াণ দিবস আজ। কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মূলত কীর্তিপাশার জমিদারের অর্থানুকূল্যে তিনি জীবনযাপন করেন।
কৈশোরে কৃষ্ণচন্দ্র এক সময় কুসংসর্গে পতিত হন। তখন বন্ধুদের পরামর্শে তিনি একবার কলকাতার কালীঘাটে পালিয়ে যান, কিন্তু ধরা পড়ে সেখান থেকে বাসায় ফিরে আসেন। পরে তার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। জমিদার-পুত্রের সঙ্গে তিনি ঢাকা আসেন এবং তার এক জ্ঞাতি ঢাকা জজকোর্টের উকিল গৌরবচন্দ্র দাসের আশ্রয়ে থেকে ঢাকার নর্মাল স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। এখানে তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন।
এ সময় থেকেই তার কাব্যচর্চা শুরু হয়। ঈশ্বর গুপ্তের উৎসাহে সংবাদ সাধুরঞ্জন ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র এক সময় স্বধর্ম ও ঈশ্বরের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন; পরে আবার শাক্ত, বৈষ্ণব ও ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।
কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ের প্রধান পন্ডিতপদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ঢাকার নর্মাল স্কুলে যোগদান করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিনি মডেল স্কুলে যোগ দেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন স্কুলে দীর্ঘ উনিশ বছর শিক্ষকতা করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। অনেক কীর্তিমান ব্যক্তি তার ছাত্র ছিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সদ্ভাবশতক’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে। নীতি ও উপদেশমূলক এ কাব্যটি পারস্য কবি হাফিজ ও সাদীর কাব্যাদর্শে রচিত। বাল্যকালে তার একটি ছদ্মনাম ছিলো রামচন্দ্র দাস, সংক্ষেপে রাম।
তাই পরিণত বয়সে তিনি রামের ইতিবৃত্ত নামে একটি আত্মচরিত রচনা করেন। মহাভারতের ‘বাসব-নহুষ-সংবাদ’ অবলম্বনে রচিত তার অপর গ্রন্থ হলো মোহভোগ । কৈবল্যতত্ত্ব তার একটি দর্শনবিষয়ক গ্রন্থ। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তার নাটক রাবণবধ। এ ছাড়া তার অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো।
তার রচনা প্রসাদগুণসম্পন্ন এবং তার কবিতার অনেক পঙ্ক্তি প্রবাদবাক্য স্বরূপ, যেমন: ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিতের বেদন, বুঝিতে কি পারে’ ইত্যাদি। এ পঙ্ক্তিধারী কবিতাটি এক সময় স্কুলপাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক মনোরঞ্জিকা ও কবিতাকুসুমাবলী নামক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হলে তিনি তার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কিন্তু এর মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞাপনী নামক পত্রিকার সম্পাদক হন। দেড় বছর পর তিনি আবার ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক পদে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় অসুস্থতার কারণে সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।
এর দীর্ঘকাল পরে ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে যশোর থেকে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় দ্বৈভাষিকী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। কবিতাকুসুমাবলী ছিলো পদ্যবহুল মাসিক পত্রিকা। তার সদ্ভাবশতক কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শেষ জীবনে কৃষ্ণচন্দ্র সেনহাটিতে বসবাস করেন এবং বিবিধ রকমের সঙ্গীত রচনা করে অবসর জীবন কাটান। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি প্রয়াত হন।