রাজধানীতে এক নারীর তিন বিয়ে ও তিন সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দাম্পত্য কলহের সূত্রে এক ব্যক্তিকে জুলাই মাসে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র হত্যা মামলায় আসামি করার ঘটনায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।
আবার ওই হত্যা মামলায় নিহতের পরিবারের কেউ বাদী না হওয়ায় এবং প্রাইভেট শিক্ষক বাদী হওয়ায় রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। এজাহারে উল্লিখিত যাত্রাবাড়ীতে ইফাত হাসান খন্দকার (১৬) নামের ছাত্র নিহতের ঘটনার সময় সারওয়ার জাহান বাপ্পী নামে ওই ব্যক্তি বসুন্ধরা এলাকার বাসায় ছিলেন এমন প্রমাণ থাকায় হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পড়েছেন গোলকধাঁধায়। এর আগে ওই ব্যক্তির নামে তার স্ত্রী বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচটি মামলা করেন। সেসব মামলা বিচারাধীন। বাপ্পীও তার স্ত্রীর নামে দুটি মামলা করেছেন, যার একটি বিচারাধীন, আরেকটির নিষ্পত্তি হয়েছে। স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে রুকাইয়া তাহসিনা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন টেলিভিশন ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের প্রযোজক সারওয়ার জাহান বাপ্পী। ভালোমন্দ মিলিয়ে চলছিল তাদের সংসার। তাদের ঘরে জন্ম নেয় তিন সন্তান। এক সন্তানের ক্যানসার ধরা পড়ে। সন্তানের চিকিৎসার সময় সারওয়ার বুঝতে পারেন তিনিসহ তিন স্বামীর সংসার করছেন তার স্ত্রী। অন্য দুই স্বামীও জানেন ওই তিন সন্তান তাদের।
সারওয়ার দাবি করেছেন, তিন বিয়ের বিষয়টি জানাজানি হলে ধামাচাপা দিতে তাকে পাঁচটি মামলার আসামি করেন তাহসিনা। সর্বশেষ সারওয়ার ডিভোর্সের পথে হাঁটলে হুট করেই যাত্রাবাড়ী থানার জুলাই-আগস্ট ছাত্র হত্যার একটি মামলার আসামির তালিকায় তার নাম দেখে দেখতে পান। সারওয়ার অভিযোগ করছেন, হয়রানি বাড়াতে স্ত্রীই মামলাবাজ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওই মামলায় তার নাম জুড়ে দিয়েছেন।
এর আগে স্ত্রীর বিরুদ্ধে সারওয়ারের করা একটি মামলা তদন্ত করে তাহসিনার প্রতারণা ও তিন বিয়ের সত্যতা পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। স্ত্রীর হয়রানি থেকে বাঁচতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সারওয়ার জাহান। এমনকি তার স্ত্রীর সন্তানদের পরিচয় পাল্টে অন্য স্বামীর সঙ্গে সংসার করার পাঁয়তারা করায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। সবগুলো মামলা থেকে মুক্তি ও সন্তানদের ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা থেকে রেহাই চাইছেন ভুক্তভোগী এই প্রযোজক। যদিও তার স্ত্রী তাহসিনা এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তাহসিনা দাবি করেছেন, স্বামীর পরকীয়া সম্পর্কের কারণে তাদের সংসারে ফাটল ধরেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় গত ২০ জুলাই ইফাত হাসান খন্দকার গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় আদালতে করা হত্যা মামলায় ১১৮ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ নম্বর আসামি করা হয়েছে সারওয়ার জাহানকে। তাকে ঢাকার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার বাদী কাউছার আলম বলেন, ‘ঘটনাস্থলে অনেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। আমার পক্ষে সবাইকে চেনা সম্ভব হয়নি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এলাকাবাসীর সহায়তায় আমি আসামির তালিকা করেছি। তবে, কারও যদি সম্পৃক্ততা না থাকে, সে অব্যাহতি পেয়ে যাবে। এখানে আমি দোষের কিছু দেখছি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিহত ইফাতের গৃহশিক্ষক ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন শিক্ষক থাকায় পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে গেছেন। যেহেতু ইফাতের বাবা বেঁচে নেই, সেহেতু দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে তিনিই মামলা করেছেন।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বাদী কাউছার আলম আসামিদের একটি তালিকা নিয়ে এসেছিলেন। আমিই তাকে একটি তালিকা প্রস্তুত করে আনতে বলেছিলাম, যাতে মামলার ড্রাফট করতে সময় কম লাগে। মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআই।’
মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহিনুজ্জামান বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। তবে যদি কাউকে হয়রানি করতে আসামি করা হয়, তাহলে আমাদের কাছে আসতে পারে। আমরা যাচাই-বাছাই শেষে তাকে যাতে কোনো হয়রানির মধ্যে পড়তে না হয় সে নিশ্চয়তা দেব।’
মামলার আসামি হওয়ার পেছনে সারওয়ারের করা অভিযোগের বিষয়ে স্ত্রী তাহসিনা বলেন, ‘সারওয়ার মানুষ খারাপ হলেও এই মামলায় আসামি হওয়া মানায় না। কারণ সে কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সারওয়ারের বিরুদ্ধে কেন এমন অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটি জানি না। পারিবারিক কোনো বিষয়ে মামলা করতে হলে আমি নিজে বাদী হয়ে মামলা করব। ইতিমধ্যে ভরণপোষণ, ধর্ষণ, মানহানিসহ পাঁচটি মামলা করেছি। যেগুলো বিচারাধীন রয়েছে।’
সারওয়ার জাহান বাপ্পী বলেন, ‘২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তাহসিনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। এর আগে তার বিয়ে হয়েছিল এটি আমার কাছে লুকানো হয়। নিজেকে কুমারী দাবি করে আমার সঙ্গে সংসার করতে থাকে। আমাদের ঘরে আহিল সারওয়ার, সেহেরী সারওয়ার ও স্বাধীন সারওয়ার নামে তিন সন্তান জন্ম নেয়। আহিলের ক্যানসার ধরা পড়লে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করি। তখনই আমি জানতে পারি তাহসিনার আরও স্বামী রয়েছে। একজন প্রবাসে, আরেকজনের কাছে মাঝেমধ্যে যাতায়াত করে। ওই স্বামীরা আমাকে কাবিননামা পাঠালে হতভম্ব হয়ে যাই। তখন থেকেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাহসিনা সদুত্তর না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু করে। একে একে পাঁচটি মামলা করে।’