
বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি ছিলো তার কাব্যসাধনার প্রধান অনুষঙ্গ। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম। জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিসর্গের রূপকার। রূপসী বাংলার কবি। তার প্রকৃতি ভাবনায় উঠে এসেছে-ফুল-ফল, পশু-পাখি, নদ-নদী, আকাশ, মাটি, কুয়াশা, শিশির, বৃক্ষ ইত্যাদি। ঋতু বৈচিত্র্য কবির লেখায় বহুবার উঠে এসেছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতিতে যেমন বদল আসে তেমনি মানব মনে আসে মন মাতানো অনুভূতি। গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা, শরৎ থেকে হেমন্ত, শীত থেকে বসন্ত কোন ঋতু বাদ যায়নি কবির ভাবনা থেকে। কবির এক একটি কাব্যগ্রন্থ যেনো এক একটি প্রকৃতি প্রেমের আখ্যান।[inside-ad]
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় প্রকৃতি ও রূপকথা আর সৌন্দর্যের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন।
কবির ঋতুকেন্দ্রিক কবিতা ‘পাখিরা’। এ কবিতায় পাখির জীবনচক্রে শীত ও বসন্তের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘কোথাও জীবন আছে,-জীবনের স্বাদ রহিয়াছে,/কোথাও নদীর জল রয়ে গেছে - সাগরের তিতা ফেনা নয়,/খেলার বলের মতো তাদের হৃদয়/এই জানিয়েছে;/কোথাও রয়েছে পড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে/তারা আসিয়াছে।’ কবি আরো লিখেছেন- ‘আজ এই বসন্তের রাতে/ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;/ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,/স্কাইলাইট মাথার উপর,/আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।’
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক'-এ ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে’-তে প্রেম নিবেদন করে কাউকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনা এসেছে কবির মনে। এ কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর প্রসঙ্গ এসেছে। মালতী লতার বন, হেমন্তের হিম ঘাস, কদম ফুল, কেয়া ফুল, শরতের ভোর কোনো কিছুই বাদ যায়নি। কবির কথায়: ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে/বকের পাখার ভিড়ে, বাদলের গোধূলি-আঁধারে,/মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,/ নিঝুম ঘুমের ঘাটে,- কেয়াফুল,- শেফালীর দলে!/-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে।’
‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থে কবি প্রকৃতির অ্যাখান তুলে ধরেছেন। গ্রামের চারপাশের পরিচিত দৃশ্যের ছবি এঁকেছেন কবিতায়। ফুল গাছ, পাখি, গ্রীষ্মের কালবৈশাখী, হেমন্তে শীতের আগমনী বার্তা, ডাহুকী পাখির গান- সবই যেন প্রকৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ঝরাপালকে ৩৫টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থে ঋতু বৈচিত্র্য, বর্ষা, শীত, গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশ, অশান্ত কালবৈশাখী, হিঙল মেঘ, শিরীষ ফুল ইত্যাদিও প্রসঙ্গ এসেছে। ‘ডাহুকী’ কবিতায় গ্রীষ্মকালের পরিবেশ, গ্রীষ্মের নিরালা দুপুর, আকাশ, ফুল, ফল, পাখির ছবি এঁকেছেন। [inside-ad-2]
‘কবি’ কবিতার হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ টেনে কবি প্রকৃতির নানা দৃশ্যের মাঝে মানসীর রূপ দেখেছেন। ঘাসের বুকে শিশিরের সঙ্গে মানসীর সৌন্দর্য মিশে যেতে দেখেছেন। তাই লিখেছেন- ‘হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুড়ে/বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!/হয়তো শুনেছ তারে,-তার সুর,- দুপুর- আকাশে/ঝরাপাতা-ভরা মরা দরিয়ার পাশে/বেজেছে ঘুঘুর মুখে,- জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়/হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পূবালি হাওয়ায়!’
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ তে কবি প্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রেমের যোগসূত্র করেছেন। প্রকৃতি যে কতো প্রকার রূপকে ধারণ করতে তারই ছবি এঁকেছেন এ কাব্যগ্রন্থে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দৃশ্যের বর্ণনায় মুগ্ধ হয়ে ধূসর পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলিকে ‘রূপচিত্রময়’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। গ্রাম্য প্রকৃতি ও ঋতুর এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে এ গ্রন্থে। কবি বুদ্ধদেব বসু এ কাব্যগ্রন্থ পড়ে বিমোহিত হয়েছিলেন। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে জীবনানন্দকে- ‘প্রকৃতির কবি’, ‘নির্জনতম কবি’ অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ধূসর পাণ্ডু লিপি কবিতার প্রথম কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর। এ কবিতায় মৃত্যুর প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনিভাবে কবি তার মানসীকে বহকাল ধরে বিভিন্ন ঋতুতে খুঁজে বেরিয়েছেন। ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায় কবি জীবন ও মৃত্যু চেতনার সাথে প্রকৃতিকে এনেছেন। হেমন্তের পর শীত ঋতু, নারী, ফুল, নদী, চাঁদ, জোনাকির ছবি দেখেছেন।
‘প্রেম’ কবিতায় কবি বলেছেন, জন্ম, মৃত্যু ও প্রেম সহজাত। প্রেম অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি এটাও ধারণা করেছেন, পৃথিবীর প্রাণ ও প্রকৃতি একদিন ধ্বংস হবে। কবি বারবার বাংলার প্রকৃতির কাছে ফিরে এসেছেন। প্রকৃতির সাথে কবিতাকে মিশিয়েছেন নাকি কবিতার সঙ্গে প্রকৃতি মিশিয়েছেন সেটা পাঠকই বলবে। তবে মনে হয়েছে প্রকৃতি আর কবিতা কবির কাছে সমার্থক রূপ। কেবল তার পক্ষে বলা মানায়, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’।
‘আবার আসিব ফিরেৎ কবিতায় কবি শঙ্কচিল শালিকের বেশে, ভোরের কাক হয়ে ফিরে আসতে চেয়েছেন। কবির ভাষায়: ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’।
পদ্মা, মেঘনা, ধানসিড়ি, জলসিড়ি এই নদীর বুকে কবি মিশে যেতে চেয়েছেন। ‘রুপসী বাংলা’ কবিতাগুচ্ছে কবির প্রতিটি কবিতায় কোনো না কোনোভাবে বাংলার রূপের কথা এসেছে। বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা এসেছে। প্রকৃতিপ্রেমের রূপকার জীবনানন্দ বাংলার রূপ-রস-সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে গেয়ে ওঠেন: 'তোমরা যেখানে সাধ চ'লে যাও- আমি এই বাংলার পারে/র'য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;’ -‘তোমরা যেখানে সাধ’, -(রূপসী বাংলা)।
শ্যামল বাংলার প্রতি অগাধ ভালোবাসার সূত্র ধরে তিনিই শুধু বলতে পারেন: 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর...’
বনলতা সেন কবিতায় কবি প্রেম ও প্রকৃতির চেতনাকে একাকার করে ফেলেছেন। বিষয় বৈচিত্র্য, ভাবের গবীরতা ও প্রকৃতি চেতনা তার কবিতায় বিশেষ স্থান দখল করে আছে বলে তিনি সবার থেকে স্বতন্ত্র। তিনি তাঁর কাব্যে পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকৃতি জগতকে যেভাবে কাব্যে স্থান দিয়েছেন সমসাময়িক কোনো কবি সেভাবে তা করেননি। তিনি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন প্রকৃতিই সত্য, প্রকৃতিই সর্বোত্তম। বাংলার প্রকৃতির মাঝেই জন্মগ্রহণ করেছেন কবি। প্রকৃতিকে ভালোবেসে তার রূপে মুগ্ধ হয়েছেন বারংবার। তাইতো রূপসী বাংলায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন ধানসিঁড়ির তীরে।
লেখক: শিক্ষক