
আজ ১৫ মার্চ। আরজ আলী মাতুব্বরের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের লামছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে তিনি ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রকৃত নাম ‘আরজ আলী’ হলেও আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাদে ‘মাতুব্বর’ নাম ধারণ করেন। তিনি একজন দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও লেখক। স্ব-শিক্ষার মাধ্যমে তার প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির দ্বারা জগত ও জীবনকে দেখেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় বেশি লেখাপড়া আর হয়ে ওঠেনি। জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তাই লাইব্রেরিকে বিদ্যালয় ভেবে নিয়েছিলেন। লাইব্রেরিতে পড়ালেখার সময় তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, মার্ক্স ও রুশোর মতো মহান দার্শনিকদের প্রেমে পড়েছিলেন। তার সম্পর্কে বলা হয়, ৮৫ বছরের জীবনে প্রায় ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে জ্ঞান সাধনায় নিজেকে মগ্ন রেখেছিলেন। তার পড়ালেখার প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস, প্রকৃতি ইত্যাদি। জীবন, জগত, ধর্ম ও প্রকৃতি ভাবনার মতো বিভিন্ন বিষয় তার লেখায় উঠে এসেছে। বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী এই চিন্তাবিদ অজ্ঞতা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। তার লেখালেখিতে যুক্তিবাদী, প্রজ্ঞা ও দর্শনের ছাপ থাকায় বিজ্ঞ মহলের অনেকেই তাকে ‘বাংলার সক্রেটিস’ বলে অবিহিত করেছেন। তার চিন্তা ও দর্শন লিপিবদ্ধ করার তাগিদে তিনি বিভিন্ন লেখা গ্রন্থ আকারে বের করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। যা পরবর্তীতে তাকে বরিশাল ও পুরো দেশে খ্যাতি এনে দেয়। তিনি প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন। জানার আগ্রহ থেকে লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন দিনের অধিকাংশ সময়। তার প্রশ্নের ওজন বা শক্তি দেখে অনেক তথাকথিত প্রজ্ঞাবানও ঘাবড়ে যেতো!
লেখালেখির জন্য পাকিস্তান সরকারের আমলে তিনি সমালোচিত ও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এ কারণে সে সময় তার লেখালেখির বিষয় জনসম্মুখে আসেনি। তার মূল্যবান গ্রন্থসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘সত্যের সন্ধানে’। দেশ স্বাধীনের পর গ্রন্থটি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। যদিও বইটি লিখেছিলেন তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে। বইটি প্রকাশের সঙ্গে শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বইটিতে ৬টি শ্রেণিতে বহু প্রশ্ন ও তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা সামনে এনেছেন। বইটিতে তিনি ‘প্রকৃতি বিষয়ক’ ১১টি প্রশ্ন ও তার যৌক্তিক উত্তর তুলে ধরেছেন। যা আজও প্রাসঙ্গিক ও আলোচনার দাবি রাখে। প্রকৃতি বিষয়ক তার প্রথম প্রশ্ন ছিলো, মানুষ ও পশুতে সাদৃশ্য কেনো? এভাবে তিনি একে একে আকাশ কী? দিবা-রাত্রির কারণ কী? পৃথিবী কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত? ভূমিকম্পের কারণ কী? বজ্রপাত কেনো হয়? রাতে সূর্য কোথায় থাকে? ঋতুভেদের কারণ কী? জোয়ার-ভাটা হয় কেনো?, উত্তাপবিহীন অগ্নি কীরূপ? মহাপ্লাবন পৃথিবীর সর্বত্র হইয়াছিলো কী? প্রশ্নসমূহ করেছেন। এসব প্রশ্ন সম্পর্কে তখন অনেক মিথ ও কল্পকাহিনী ছড়িয়ে ছিলো জনমনে। আরজ আলী মাতুব্বর এসব প্রশ্নের যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন সহজভাবে।
মানুষ ও পশুর সাদৃশ্য অংশে তিনি বলেছেন, মানুষের রক্তের প্রধান উপাদান শ্বেত কণিকা, লোহিত কণিকা, জল ও লবণ জাতীয় পদার্থ। আর দেহ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়-লৌহ, কার্বন, ফসফরাস ও আরো কিছু মৌলিক পদার্থ। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী ক্ষয় পূরণের জন্য আহার করে। পৃথিবীতে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন- বাঘ মানুষ আহার করে, মানুষ মাছ ভক্ষণ করে, আবার মাছ ছোট মাছ ও পোকা মাকড় খায়। তিনি বলেছেন, এক প্রাণীর ক্ষয়মান পদার্থ অন্যের শরীরে আছে। পৃথিবীতে আসা নতুন শিশুও গরুর দুধ খেয়ে জীবন ধারণ করে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে গাভী ও প্রসূতির দেহের উপাদান এক নয় কি? তিনি বলেছেন, মানুষ ও অনেক পশুর শরীরে একই পরজীবী বাস করে। প্লেগ ও জলাতঙ্কের রোগ ইতর প্রাণী হতে মানুষে ও মানুষ হতে ইতর প্রাণীতে ছড়ায়। প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে মানুষ ও পশুর স্নায়ু ও রক্তের সাদৃশ্য প্রমাণিত হয় কি না? আকাশ, চন্দ্র ও সূর্য সম্পর্কে সব কল্পকথা ও মিথ দূরে সরিয়ে বলেছেন আকাশে বহু জোতিষ্ক রয়েছে এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের ও সূর্যের দূরত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের কথায় সত্য। তিনি বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহষ্পতি ও শনি মোট ছয়টি গ্রহের উল্লেখ করেছেন। তিনি তুলে ধরেছেন সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা। ইহাকে বলা হয় সৌর বছর। আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুপাত থেকে প্রকাণ্ডরূপে লাভার উদ্গিরণের সময় বা প্রাকৃতিক কারণে ভূকম্পন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, আকাশের মেঘে যে বিদ্যুৎ থাকে তার চেয়ে মাটিতে আবিষ্ট বিদ্যুৎ শক্তি বেশি হলে তা আকাশের বিদ্যুৎকে মাটিতে টেনে নিয়ে আসে। বজ্ররোধক ব্যবহার করলে কেনো বজ্রপাত হয় না, বজ্রপাত কেনো উঁচু স্থানে হয়, সব মেঘ ও শীতকালের মেঘে কেনো বজ্রপাত হয় না, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা তিনি তুলে ধরেছেন গ্রন্থটিতে। তার ব্যাখ্যায় এসেছে, সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়ার ফলে গ্রীষ্মকাল ও তির্যকভাবে কিরণ দেয়ার ফলে শীতকাল হয়। তিনি দেখিয়েছেন, রাত-দিনের বিচারে আমেরিকা আমাদের ঠিক বিপরীত অবস্থানে। পৃথিবীর যে অংশে দিনে দুইবার জোয়ার-ভাটা হয়, ঠিক বিপরীত অংশেও একইভাবে জোয়ার-ভাটা হয়।
তার প্রকৃতিভাবনা বর্তমানের একজন প্রকৃতি ও পরিবেশ বিজ্ঞানীর থেকেও কম ছিলো না। বিভিন্ন প্রশ্ন ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি জনমুখে সৃষ্টি কুসংস্কার দূরে ঠেলে সত্যটা সবার সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে, জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই। তার দর্শনের দ্বারা তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার দূরে রেখে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। জ্ঞান সাধনার জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যপদ লাভসহ অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। মৃত্যুর পর নিজের দেহও দান করে গেছেন মহান এই দার্শনিক। বরিশাল মেডিক্যাল িকলেজ শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করেন তিনি। তার কর্মজীবন ও জ্ঞানসাধনা বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শস্বরূপ।
লেখক: শিক্ষক