
বিশ্বের এক নম্বর বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কিকে ‘প্রফেট/প্রফেট অব কনসান্স’ বলেছিলেন সমাজ সংস্কারক, বুদ্ধিজীবী ও লেখক মিজানুর রহমান খান। সময়টা ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল। ই-মেইলে মিজানুর রহমান খান তাঁকে সম্বোধন করলেন, ‘প্রফেট/প্রফেট অব কনসান্স’ হিসেবে। উত্তরে চমস্কি লিখলেন: ‘আমি প্রফেট হওয়া থেকে যোজন যোজন দূরে।’
এ বিষয়ে মিজানুর রহমান খানের এক লেখায় জানতে পারি, ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকায় ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল নোয়াম চমস্কির সাক্ষাৎকারের শুরুটাই ছিল আকর্ষণীয়। ওই সময়কার বাংলাদেশ পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। চমস্কিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অগণতান্ত্রিক শাসন ও দুর্নীতির জন্য সমালোচিত থাই প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাত হন। সামরিক হস্তক্ষেপ কি কখনো গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনতে পারে?
চমস্কির জবাব ছিল: নীতিগতভাবে হ্যাঁ। প্রায় সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু একটি সরকার উৎখাতে ‘এ ভেরি হেভি বার্ডেন অব প্রুফ’ অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগ যে বৈধ ছিল এর সপক্ষে যথেষ্ট জোরালো সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখাতে হবে। ওয়াশিংটনেও বড় ধরনের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু তা সেনা হস্তক্ষেপকে যথার্থতা দেয় না।[inside-ad-1]
থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর বিশেষজ্ঞ-জ্ঞান ছিল না। একথা উল্লেখ করেও তিনি বলেন, থাকসিনের ক্ষেত্রে ওই শর্ত পূরণ হয়নি।
আরো পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বিশেষ সাক্ষাৎকার
মিজানুর রহমান খানের এক লেখায় পাই, নোয়াম চমস্কির ওই ‘বার্ডেন অব প্রুফ’ কথাটি সম্ভবত তাঁর ক্ষমতাবিষয়ক তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি মনে করেন ‘ক্ষমতা সর্বদাই অবৈধ। এর বৈধতা সব সময় প্রমাণসাপেক্ষ এবং এর দায়
কর্তৃপক্ষের। যদি তাঁরা জনগণের সামনে তেমন প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের উচিত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া।’
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ এপ্রিল মিজানুর রহমান খান চমস্কিকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তর পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন জনাব খান।
প্রথম প্রশ্ন ছিল, ব্যাংককের সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে আপনি ‘হেভি বার্ডেন অব প্রুফ’ সাপেক্ষে সেনাহস্তক্ষেপের সপক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, তাহলে আপনি এ কথাও বলে দিন যে, ওই ধরনের সংবিধানবহির্ভূত পদক্ষেপের চূড়ান্ত বৈধতার প্রশ্ন কীরূপে নিষ্পত্তি হতে পারে?’
এর জবাবে নোয়াম চমস্কি সতর্ক। তাঁর কথায়, ‘সম্ভবত আমার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। আমি মনে করি না যে, ব্যাংককের ঘটনায় সাক্ষ্য-প্রমাণের শর্ত পূরণ করা হয়েছিল এবং এমন কোনো উপায় আছে যার মাধ্যমে ওই অভ্যুত্থানের বৈধতার প্রশ্ন নিষ্পত্তি সম্ভব।’
চমস্কির কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন: আপনি কি দয়া করে ইতিহাসের পাতা থেকে এমন কোনো দৃষ্টান্ত হাজির করবেন, যেখানে আমরা দেখতে পাব যে, সামরিক নেতারা সাফল্যের সঙ্গে টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবর্তন বা সুশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন? [inside-ad-2]
নোয়াম চমস্কি এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ‘যদি’ শব্দটির ওপর ভর করেন। তাঁর কথায়, ‘যদি আমরা গণতন্ত্র ও সুশাসনকে অর্থনীতি ধ্বংস, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদির মতো অন্য প্রভাব থেকে মুক্ত করে সংকীর্ণ আনুষ্ঠানিক অর্থে দেখি, তাহলে অনেক উদাহরণই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতে ব্রিটিশ উপস্থিতির কথা বলা যায়।’
চমস্কি যেকোনো দখলদারিত্বের বিরোধী। তিনি ভারতে ব্রিটিশ দখলদারিত্বকে হরিফাইয়িং অকুপেশন বা আতঙ্কজনক দখল হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই হরিফাইয়িং অকুপেশন তাঁর কথায়, ‘গণতন্ত্রের জন্য কিছুটা ভিত্তি এবং তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।’ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজও পড়ানো হয়, ব্রিটিশ শাসন আশীর্বাদ না অভিশাপ? অনেকে মনে করেন দুটোই। অনেকের মতে এটা অভিশাপ। ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের না হয়ে আমরা সে ক্ষেত্রে হয়তো নিজস্ব ধারার উত্তম শাসনব্যবস্থা গড়তে পারতাম।
মিজানুর রহমান খানের তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে বিশ্বনন্দিত মানবতাবাদী যা বলেছেন তা-ই শ্রেষ্ঠ। এবং বাংলাদেশের সমকালীন পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষণীয় তো বটেই। ‘আপনি বর্তমান বিশ্বের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্ব/উন্নয়নশীল বিশ্বের সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা সেনাশাসনের প্রবণতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?’
নোয়াম চমস্কি: ‘Pretty much as in the past, It is undertaken for the benefit of those who intervene, almost invariably, with the effects on the victims incidental.’ [অতীতের মতোই বেশি। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাঁদের স্বার্থেই, যাঁরা হস্তক্ষেপের কাজটি করেন এবং এরূপ স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি সব ক্ষেত্রেই প্রায় সমান। আর ভুক্তভোগী জনগণের ওপর এর প্রভাবও কিন্তু আনুষঙ্গিক অর্থাৎ সামরিক শাসন এলে এর একটি ক্ষতিকর প্রভাব তাঁদের ওপর আপনাআপনি পড়ে যায়।]