ভারতের গুজরাটে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যে ঘটনাগুলো সবথেকে বীভৎস বলে মনে করা হয়, তারই অন্যতম 'গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা'। আহমেদাবাদের গুলবার্গ আবাসিক এলাকায় কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য এহসান জাফরিসহ ৬৯ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি ওই ঘটনার পর থেকে প্রায় দুই দশক ধরে আইনি লড়াই চালিয়েছেন। গত শনিবার মারা গেছেন মিসেস জাফরি।
গুলবার্গ সোসাইটির গণহত্যা মামলায় মিসেস জাফরি ৬৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
জাকিয়া জাফরির আবেদনের ভিত্তিতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছিল।
মিসেস জাফরির পুত্র তনভির জাফরি বিবিসিকে বলেছেন, "বয়স-জনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন মা। আমার বোন নিসরিনের কাছেই থাকছিলেন তিনি। শনিবার সকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে আনা হয়, তবে বেলা ১১.৩০ নাগাদ মাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।"
গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা
অযোধ্যায় রামমন্দিরের 'করসেবা'য় অংশ নেওয়ার পরে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারি সবরমতী এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন অনেক হিন্দুত্ববাদী কর্মী-সমর্থক। ওই ট্রেনটিতে আগুন দেওয়া হয় গুজরাতের গোধরা স্টেশনে। ওই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ৫৮ জন হিন্দু কর-সেবক।
ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই আক্রমণ শুরু হয় গুজরাতের মুসলমানদের ওপরে, শুরু হয় স্বাধীন ভারতের সব থেকে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যাতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। নিহতদের বেশিরভাগই মুসলমান।
গোধরার ঘটনার পরের দিন যখন গুজরাতের একের পর এক এলাকায় দাঙ্গা চলছে, তারই মধ্যে আহমেদাবাদের মুসলমান প্রধান অঞ্চলের আবাসিক পরিসর গুলবার্গ সোসাইটিতে হামলা চালায় কয়েকশো হিন্দু।
সেখানেই পরিবারসহ বাস করতেন কংগ্রেস সংসদ সদস্য এহসান জাফরি।
বিবিসি গুজরাতি বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিসেস জাফরি জানিয়েছিলেন, "সেদিন অনেক মুসলমান পরিবার আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি অসুস্থ ছিলাম বলে আমার স্বামী ওপরতলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উন্মত্ত জনতা তখন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আমার স্বামী নানা জনকে ফোন করে সাহায্য চাইছিলেন। তিনি গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও ফোন করেছিলেন। কোনো সাহায্য করেনি।"
মিসেস জাফরি এটাও একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের প্রাণ বাঁচাতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক থেকে গুলি চালিয়েছিলেন।
এরপরে জনতা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। পুরো আবাসিক পরিসর ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। বাসিন্দাদের প্রথমে কোপানো হয়, তারপরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ঘরে।
জাকিয়া জাফরি ওপরের তলায় ছিলেন, তাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। তবে সেদিনই তিনি সংকল্প নিয়েছিলেন, "বিচার পাওয়ার জন্য মৃত্যুর দিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব।"
ওই আবাসিক পরিসরের কিছু বাড়ি এবং বাংলো সারানো হয়েছে, তবে বাসিন্দারা কেউ আর ফিরে যাননি সেখানে।
নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেন জাকিয়া
মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় এক জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন জাকিয়া জাফরি। বুরহানপুরের আইনজীবী এহসান জাফরির সঙ্গে বিয়ের পরে তারা গুজরাতে আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে তারা আহমেদাবাদের চমনপুরায় একটি 'চাওল'এ (বস্তির মতো এলাকা) থাকতেন।
সেই বাড়িটি ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের দাঙ্গায় ধ্বংস হয়ে যায়। সেই জায়গাতেই গড়ে উঠেছিল গুলবার্গ সোসাইটি আবাসিক পরিসর।
গুজরাত দাঙ্গার পরে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন জাকিয়া জাফরি।
নরেন্দ্র মোদী কোনোরকম নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছেন, দাঙ্গার জন্য কখনও দুঃখপ্রকাশও করেননি।
জাকিয়া জাফরির বক্তব্য ছিল, গুলবার্গ সোসাইটির হামলার সময় মি. মোদীসহ কেউই সাহায্য করেননি ইচ্ছা করে। রাজ্যের পুলিশ মহানির্দেশকের কাছে এই অভিযোগ দায়ের করার জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। তবে সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়।
পরে গুজরাট হাইকোর্টও তার আবেদন খারিজ করে দেয়।
এরপরে তিনি আবেদন জানান সুপ্রিম কোর্টে। সর্বোচ্চ আদালত একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করার নির্দেশ দেয় গুজরাত দাঙ্গার সব মামলাগুলোর তদন্ত করার জন্য।
সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ওই ঘটনার তদন্ত চালায় একটি বিশেষ তদন্তকারী দল।
নরেন্দ্র মোদীকে তদন্তে তলব
বিশেষ তদন্তকারী দলটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নরেন্দ্র মোদীকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই তারা প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে।
তবে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ওই তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্টে গুজরাত দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খারিজ করে দেওয়া হয়।
জাকিয়া জাফরি বিচার বিভাগীয় সেই তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গুজরাত হাইকোর্টে একটি আপিল করেন। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়।
মিসেস জাফরি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে দাঙ্গা নিয়ে নতুন তদন্তের আবেদন করেন। মামলায় তার অভিযোগ ছিল তদন্তে "ষড়যন্ত্রকারীদের সুরক্ষা" দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিনের আইনি টানাপোড়েনের শেষে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি বিশেষ আদালত যে ২৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল তার মধ্যে ১১ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বাকিদের মধ্যে ১২ জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং এক জনকে দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
ওই রায় দিতে গিয়ে বিশেষ আদালত গুলবার্গ সোসাইটির গণহত্যাকে 'নাগরিক সমাজের সব থেকে কালো দিন' বলে বর্ণনা করেছিল।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাকিয়া জাফরি বলেছিলেন, "এদের আমি কী করে ক্ষমা করব? আমার দিনগুলো কি ফিরে আসবে তাতে? যারা দোষী তাদের শাস্তি পেতেই হবে এবং একমাত্র তাহলেই ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর হবে না।"
বিশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মিসেস জাফরি প্রথমে গুজরাত হাইকোর্টে, তারপরে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে নরেন্দ্র মোদীসহ ৬০ জন অভিযুক্তকেই 'ক্লিন চিট' দেয়।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে বিচারের জন্য মৃত্যুর দিন পর্যন্ত লড়াই করে যাবেন তিনি।
করেছেনও ঠিক সেটাই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা